এইচ.এম কামরুয্যামান: ২০১০ সালের ২৫শে ফেব্র“য়ারির বৃহস্পতিবার একটি স্মরণীয় দিন। এই দিন দিবাগত রাতে চির বিদায়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন সিলেট বিভাগের শীর্ষস্থানীয় কওমি মাদরাসা ঐতিহ্যবাহী জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের দীর্ঘকালীন মুহতামিম ও আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর জামে মসজিদের সুদীর্ঘ ৫৬ বছরের ইমাম ও খতিব বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন প্রচারবিমুখ বুযুর্গ আল্লামা শায়খ আবদুল হাই রাহ.।
কি সৌভাগ্যপূর্ণ ইন্তেকাল ছিল তার। মৃত্যর সময় আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। কিভাবে হয়েছে সেটা আল্লাহই ভালো জানেন। কিন্তু এখানে আমাদের অনেক শেখার আছে। ভাবার আছে অনেককিছু। তিনি কিভাবে অর্জন করেছিলেন এমন সৌভাগ্য ও নেয়ামত। এমন সৌভাগ্য কেবল দৈহিক শক্তির বলে অর্জন করা যায় না; বরং আল্লাহ প্রেমে নবীওয়ালা কাজে যারা সাধনা করে তারাই এরূপ সৌভাগ্য অর্জন করে থাকে। তিনি প্রায়ই শুক্রবারে মাওলায়ে হাকিকির সাথে সাক্ষাৎ লাভের দুয়া করতেন। আল্লাহ তাঁর এ প্রার্থনাকে কবুল করেছেন। তিনি শুক্রবারেই ইন্তেকাল করেন। ২৬ ফেব্র“য়ারি ২০১০ ইংরেজি, মোতাবেক ১১ই রবিউল আউয়াল ১৪৩১ হিজরি বেলা ১টা ১০ মিনিটে জুমুআর নামাযের সময় স্বীয় স্ত্রী, দুই ছেলে, তিন মেয়েসহ অসংখ্যা ভক্ত মুরিদান ও জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের ওস্তাদ-ছাত্রদেরকে শোক সাগরে ভাসিয়ে আপন রফিকে আলার সঙ্গে মুলাকাত করেন।
অন্তিম মূহূর্তে হযরতের দাফনকার্য কোথায় হবে? তার বিরামহীন মেহনতের ফসল জামিয়া উদ্যানে নাকি বাড়িতে? এ নিয়ে জামিয়ার ছাত্র-শিক্ষক এবং এলাকাবাসী দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। সঙ্গত কারণে অনেকে বলতে লাগলেন জামিয়া উদ্যানেই তার দাফন হওয়া চাই। তিনি দীর্ঘদিন থেকে জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের মুহতামিম ও আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর জামে মসজিদের একাধারে ৫৬ বছরের ইমাম ও খতিব। হুযুর মুহতামিম থাকাকালে জামিয়ার নতুন ভবনের জায়গাদাতা, লন্ডন প্রবাসী জনাব শফিক আহমদ হুযুরকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “হুযুর, আপনি যদি রাযি হন তাহলে আপনার মৃত্যুর পর আপনার লাশটা যেন জামিয়া উদ্যানে সমাহিত করা হয়” তার এ কথা শুনে হুযুর কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন, আমার কি এমন সৌভাগ্য হবে? এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, হুযুরের আগ্রহ, তার অন্তিম ইচ্ছা স্বীয় লাশটা যেন শেষ মুহূর্তে পরম প্রিয় প্রতিষ্ঠান জামিয়া উদ্যানেই সমাহিত করা হয়। হুযুরের ইন্তেকালের খবর শুনে জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরে অবস্থানরত ওস্তাদ-ছাত্র, জামিয়ার ফাযিল ও ভক্তরা হুযুরকে শেষবারের মতো দেখতে তার বাড়িতে ছুটে যান। হুযুরের মৃতদেহ দেখার পর জামিয়ার ওস্তাদ-ছাত্র, এলাকার ভক্ত-শুভাকাঙ্খীরা জামিয়ার দীর্ঘকালের নাযিমে তা’লিমাত, বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মাওলানা শায়খ জিয়াউদ্দিন কে বললেন, হুযুরের লাশ কোথায় দাফন হবে এ নিয়ে হুযুরের পরিবারের সাথে আলোচনা করুন। তখন মরহুম মুহতামিম সাহেবের ছোট ভাই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হাফিয আবদুশ শাকুর সাহেব ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। সবাই তার বাড়িতে আসার অপেক্ষায় অধীর হয়ে রইলেন। হাফিয আবদুশ শাকুর সাহেব মাগরিবের পর বাড়িতে আসেন। তিনি আসার পর জামিয়ার শিক্ষক-ছাত্রবৃন্দ এবং আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর তথা জামিয়ার এলাকার বিশেষ মুরব্বিগণ জামিয়ার জায়গাদাতা, আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের লন্ডনপ্রবাসী বিশিষ্ট মুরব্বি জনাব শফিক আহমদের ঐকান্তিক কামনা, এলাকাবাসীর আন্তরিক আগ্রহ এবং জামিয়া ও ইসলামি শিক্ষার উন্নতিকল্পে এবং ফায়েয ও বরকত লাভের অপার্থিব আশায় হযরত শায়খ আবদুল হাই রাহ. কে জামিয়া উদ্যানে দাফন করার অনুমতি প্রদানের জন্য তার কাছে আবেদন করেন। হাফিয আবদুশ শাকুর সাহেব পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে জানালেন, পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করাই আমাদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। আপনাদের আবদার রাখতে পারলাম না বলে দুঃখিত। তার পরও জামিয়া কর্তৃপক্ষ ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে পারিবারিক সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা করার জোরালো আবদার রাখা হয়। কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন।
পরদিন বিয়ানীবাজার পি,এইচ,জি হাই স্কুল মাঠে প্রায় ন’টা থেকে কফিনকে সামনে রেখে মরহুমের কর্মময় জীবন নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার বক্তাবৃন্দের আলোচনা চলতে থাকে। একপর্যায়ে জামিয়া এলাকার মুরব্বিগণ মনোনীত আকাখাজানা নিবাসী, বিশিষ্ট সমাজসেবক জামিয়ার মজলিসে শূরা ও আমেলার অন্যতম সদস্য আলহাজ হোসাইন আহমদ সাহেবের নাম বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মাইকে ঘোষিত হয়। তিনি তার বক্তৃতার এক পর্যায়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে যখন বললেন, “আমরা হাফিয আবদুশ শাকুর সাহেবের পায়ে ধরে আবদার করছি, যেন মরহুমের লাশকে জামিয়া উদ্যানেই দাফন করার অনুমতি দান করা হয়।” তখন জামিয়ার ফারিগ ও ফাযিল প্রাক্তন কিছু ছাত্র ও এলাকার কিছু মানুষ হাফিয আবদুশ শাকুর সাহেবের পায়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সে সময় কান্নার রোলে যে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় তা ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব। কিন্তু এত কিছুর পরও তার সিদ্ধান্তে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি বক্তৃতায় দাঁড়িয়ে তার সেই পূর্ব সিদ্ধান্তই ঘোষণা করলেন। একেবারে শেষ পর্যায়ে জামিয়ার মহামান্য শিক্ষাসচিব ও বর্তমান মুহতামিম মাওলানা শায়খ জিয়া উদ্দিন সাহেব তাঁর বক্তৃতায় বললেন, “জামিয়ার এলাকাবাসীসহ আমরা হাফিয আবদুশ শাকুর সাহেবের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করেছি। সম্ভাব্য সব ভাষায় আবদার রেখেছি; কিন্তু সব বিফল হল। কিছুই কাজে এল না। হয়তো এটাই আল্লাহর সিদ্ধান্ত। আমরা আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম। কারণ আল্লাহর সিদ্ধান্ত সর্বান্তকরণে মেনে নেওয়া প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ওয়াজিব।”
জানাযার নামায হল। ইমামতি করলেন মরহুমের কনিষ্ট ছেলে মাওলানা মাহমুদ হাসান। এ্যাম্বুলেন্সে কফিন ওঠানো হল। কফিনবাহী গাড়ি এগিয়ে চলল। এবার হযরতকে দাফন করার পালা। সবাই ধীরপায়ে মরহুমের পারিবারিক গোরস্থান সুপাতলা অভিমুখে যাত্রা করল। এরই মধ্যে আওয়াজ ওঠল থানায় লাশ আটকানো হয়েছে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষসহ সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কেউ সুপাতলা পৌঁছে গেছেন। কেউ মাদরাসা অভিমুখে, কেউবা আবার ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর বুঝা গেল এ্যাম্বুলেন্স সুপাতলা না গিয়ে জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের দিকে ছুটে চলেছে। রাস্তায় অস্বস্তিকর জ্যাম সৃষ্টি হল। গাড়ি পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াল। যাক অনেক কষ্টে যখন গলধগর্ম হয়ে সবাই জামিয়া পৌঁছলো, তখন দেখা গেল এলাকার সর্বস্তরের জনতা তাকে দাফন করার কাজে ব্যতিব্যস্ত। মাদরাসার মূল ফটকের ভিতরে বাম পার্শ্বে কবর খনন করা চলছে। সবাই যে যার মতো করে কাজ করছে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষসহ কারো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এরপর মরহুমের মৃতদেহ কবরে সমাহিত করা হল। আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর এলাকাবাসী ফিরে পেল তাদের শ্রদ্ধাস্পদ সেই ইমাম সাহেব তথা জামিয়ার প্রাণ পুরষকে। আর হুযুরের অন্তিম আগ্রহও সার্থক হল। শত বাধা উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত চিরদিনের জন্য সমাহিত হলেন জামিয়া মাদানিয়ার নৈস্বর্গিক উদ্যানে।
লেখক
শিক্ষার্থী
জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর