মুহাম্মদ ইয়াহইয়াল করীম: শুক্রবার। সূর্য আজ অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। ঋতুর পালাবদলে শুরু হয়েছে চারদিকে গনগনে উত্তাপ। এরই মাঝে বেড়াতে বেরুলাম গোলাপগঞ্জের শরিফগঞ্জে। সাথে জুনাইদ। জুমুআর নামায আদায় করি ঢাকাদক্ষিণ জামে মসজিদে। নামায পর মোবাইল ফোন অন করতেই রিংটোন বেঁজে ওঠল। একের পর এক কল আসতেই লাগল। থামছে না। যেন সে থামতে জানে না। জুনাইদ রিসিভ করেই ইন্নালিল¬াহ পড়ল। বললাম কী হয়েছে, জবাব এল, “মুহতামিম সাহেব হুজুর আর নেই ”।

মাওলানা শায়খ আবদুল হাই। আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ও অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, ছাত্র-শিক্ষক সবাই তাঁকে তাযিম করে। শ্রদ্ধা করে। পরম শ্রদ্ধা। সবার হৃদয় জুড়ে তার মুহাব্বত, তার ভালবাসা। কারণ, তিনি যে একজন খাঁটি মানুষ। তাক্ওয়া-পরহেযগারি, সততা, সত্যবাদিতা সকল সুকুমার বৃত্তিতে তিনি এক উজ্জ্বল আলোকময় নিদর্শন। মুহাম্মদপুর জামে মসজিদে এক নিরিবিলি রুমে একেবারে শান্ত পরিবেশে জীবন-যাপন করতেন। পরবর্তীতে বার্ধক্যতার কারণে চলে আসেন জামিয়ার নতুন ভবনে। সেখানে কাটিয়ে যায় কয়েকটি বছর। তাঁর রুমের ঠিক উপরের রুমটিতেই থাকতাম আমরা কয়েকজন। একরাতে ব্যথাতুর অপরূপ সুরে আমার ঘুম ভেঙে যায়। মনে হয় কোনো পরমাত্মার আহবান, এক সাধকহৃদয়ের মিলনার্ত বেদনাদীর্ণ আবেগ গুমরে উঠছে। সেই সুরে তাল মিলিয়ে জামিয়ার চার দেওয়ালও সুর তুলেছে। দরজার কপাট খুলে অনুমান করি নিচতলা হতে সে সুর ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পড়ি। আরিফ বিল্ল¬াহ মুহতামিম সাহেবের রুমের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যিকির, তিলাওয়াত ও আল্লাহর দরবারে আহাজারির ডাক শুনে নিজ স্থানে চলে যাই। হায়, কি আকর্ষণ সেই ডাকের! এই মর্মেই কবি ফররুখ আহমদের কবিতার ক’টি লাইন মনে পড়ে যায়।

রাত্রিভ’র ডাহুকের ডাক…/এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির!

দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি/ ছলনার পাশা খেলা আজ প’ড়ে থাক,

ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি/ কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।

মরহুম মুহতামিম সাহেব সময়কে তিন ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন। এক ভাগে ইবাদত-বন্দেগি করতেন। উপদেশ দিতেন। আরেক ভাগে মাদরাসার উন্নতির জন্য গ্রামে-গঞ্জে কাটাতেন। আরেক ভাগে গভীর মনোযোগসহকারে সুললিত কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তিনি ছিলেন যুগ শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, কামেল ওলি, আল্ল¬াহকে পাওয়ার জন্য কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারের যে অকল্পনীয় ঘটনা আমরা বুযুর্গানে দ্বীনের জীবনীতিহাসে পড়েছি, তার প্রতিচ্ছবি ছিলেন মাওলানা আবদুল হাই রাহ.। তিনি ছিলেন সুন্নাতের আনুগত্যকারী। রাসুল সা.এর পূর্ণ অনুসরণ, তাঁর মাধ্যমে আল্ল¬াহর সন্তুষ্টি ও ভালবাসা অর্জনই তাঁর দর্শন। মরহুম মুহতামিম সাহেব রাহ.’র স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত ইমাম মাওলানা আবদুল করিম আজো কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, “হুজুরের সারাটা জীবন ছিল সুন্নাত মাফিক। হুজুর কখনো অপরের ভুল ধরতেন না। কারো থেকে কোনো অন্যায় হয়ে গেলে বলতেন, আমার গুনাহের জন্য তা হয়েছে। ফজরের নামাযে তিওয়ালে মুফাসসাল থেকে তিলায়াত না করলে তাঁর হুজরায় নাস্তার দাওয়াত দিতেন, আর বলতেন আমি সুন্নাতের উপর আমল করতে পারি না। তোমার তো অনেক লম্বা লম্বা সুরা ইয়াদ আছে, ফজরের নামাযে তিওয়ালে মুফাসসাল থেকে তিলাওয়াত করা সুন্নাত। আবার পূর্ণ সুরা তিলাওয়াত আরেক সুন্নাত। তোমার তিলাওয়াত আমার খুব ভালো লাগে। একটু লম্বা কেরাত পড়বে।”

সেই মহাপুরুষের মৃত্যুর সংবাদ শুনে শরিফগঞ্জ থেকে দ্রুত সুপাতলায় যাত্রা করি। হুজুরকে একনজর দেখে রাত্রি যাপন করি মাথিউরার শিক্ষক, সহপাঠী আসআদ ভাইর কাছে। পরদিন জানাযা পড়তে চলে যাই বিয়ানীবাজারের পি.এইচ.জি হাই স্কুল মাঠে। জানাযার পর তাঁর মরদেহ বহণ করতে ভক্তবৃন্দের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কেনই বা প্রতিযোগিতা হবে না। ফেরেস্তাগণ ও পুণ্যবানদের রুহ নিয়ে প্রতিযোগিতা করে আকাশ পানে দ্রুত চলেন। আমরা কয়েকজন করার নিয়ে এম্বুল্যন্সের দিকে ছুটে যাই। মাঠ পার হতে চার-পাঁচ হাত প্রস্থ ড্রেইনের বাধাঁর মুখে পড়ি। ড্রেইন পারাপারের ব্যবস্থা ছিল একটি কাঠের টুকরো। এই কাঠের টুকরো দিয়ে এতসব মানুষ কিভাবে পার হব! লাশ নিশ্চই ড্রেইনে পড়বে, সাথে আমরাও। এই চিন্তা করতেই আমি চৈতন্য হারিয়ে ফেলি। একটু পরে দেখি আমরা ড্রেইনের ওপারে। হুজুরের পুণ্যদেহসহ আমাদেরকে এমন এক সত্ত্বা সাহায্য করেছে যা মানুষও নয় জিনও নয়। ড্রেইন পারাপারের চিন্তা এলে আজো আমি চৈতন্য হারিয়ে ফেলি…।

লেখক: শিক্ষক, শাহ করার মাদরাসা, সিলেট