শায়খ ফারুক আহমদ: সকল স্তুতি ও প্রশংসা সেই মহান সত্ত্বার যিনি এ বিশ্বজাহান সৃষ্টি করত যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করে তাঁর যমিনে তাঁরই মনোনীত ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর পর সাহাবা, তাবেয়ী, তব-ই তাবেয়ী, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও হক্কানি উলামায়ে কেরামের ওপর, যাদের মাধ্যমে দ্বীনে হক এর পরম্পরা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাঁদের প্রতি সালাত ও সালাম ভেজে হযরত মুহতামিম সাব রাহ. সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতার আলোকে দু’কলম লিখার প্রয়াস পাচ্ছি।
আদর্শ সমাজ গঠনে তাঁর সাধনা
তখন আমি মক্তবের ছাত্র। তাঁর আগমন ঘটেছিল আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের ইমাম সাহেব হিসেবে। পাশাপাশি দেউলগ্রাম মাদরাসায় শিক্ষকতাও করতেন। মসজিদের ইমামতির সাথে সাথে গ্রামের বিভিন্ন উন্নয়ন ও ধর্মীয় সংস্কারমূলক কাজের প্রতি মনোনিবেশ করলে গ্রামবাসী তাঁকে সাদর অর্ভ্যথনা জানিয়ে বরণ করে এবং তাঁর সাধনায় মুহাম্মদপুর একটি আদর্শ গ্রাম হিসেবে রূপ নিতে থাকে। উন্নয়নমূলক কর্মসূচির প্রথম পর্যায়ে তিনি মক্তব চাঙ্গা করার এমন পদক্ষেপ নেন, যাতে কোনো পরিবারের একটি সন্তানও মক্তবের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না থাকে। এ চেষ্টা চালাতে থাকেন। মিশে যান গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলের সাথে, সমান তালে। এবার দখল করে নেন গ্রামবাসীর হৃদয় রাজ্য। হয়ে যান সকলের মান্যবর ইমাম; যেন মুহাম্মদপুর নামক পরিবারের কর্তা। গ্রামের যে কোনো বিষয় তাঁরই পরামর্শে চূড়ান্ত হত।
জামিয়া প্রতিষ্ঠায় তাঁর বলিষ্ঠ ভুমিকা
অনিবার্য কারণবশত দারুল উলুম দেউলগ্রাম ত্যাগ করেন মাওলানা শিহাবুদ্দীন রাহ.সহ বেশ ক’জন শীর্ষস্থানীয় আলিম-উলামা। তন্মধ্যে শায়খ ইমাম সাহেব (আবদুল হাই রাহ.) অন্যতম। আল্লাহর মনোনীত বান্দাগণতো লোকসমাজে পাঞ্জেরির ভূমিকায় বিভূষিত হয়ে থাকেন। তাই দেউলগ্রাম থেকে মৌমাছির ন্যায় ছুটে আসা ছাত্ররা হযরত শিহাবুদ্দীন ও হযরত রাহ.কে বাধ্য করল মসজিদেই পড়াতে। অবশেষে পড়াতেই হল তাঁদেরকে। সূচনা হয়ে গেল জামিয়া প্রতিষ্ঠার কাজ। মাওলানা শিহাবুদ্দীন রাহ.’র তত্ত্বাবধানে ও ইমাম সাহেব রাহ.’র অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে একদিকে মসজিদে পড়াশোনা চলছিল, অপরদিকে জামিয়ার জায়গা বন্দোবস্ত করে র্নিমাণ কাজ শুরু হল। এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালে জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর রূপে এর আত্মপ্রকাশ ঘটল। ফলে আমি অধম ও সুযোগ পেলাম সেখানে ভর্তি হয়ে লেখা-পড়া করার।
পরম ত্যাগী ও দ্বীনের জন্য নিবেদিত এক নাম হযরত আবদুল হাই রাহ.
হযরতের শিক্ষকতায়ই আমার শিক্ষাকাল শুরু হয়। মক্তব থেকে মিশকাত শরিফ পর্যন্ত এখানেই অধ্যয়ন করি। এরপর দাওরায়ে হাদিস পড়ার জন্য হযরতের পরামর্শেই চলে যাই হাটহাজারিতে। এদিকে প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম মাওলানা শিহাবুদ্দীন রাহ. ইন্তেকাল করেন। মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হল মাওলানা শফিকুল হক আমকুনির হাতে। আমি দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করামাত্র হযরত রাহ.’র শুভদৃষ্টি পড়ে যায় অধমের প্রতি। তাই তাঁরই সুহবতে থেকে এ জামিয়ায় শিক্ষকতার সুযোগ হয়।
সময়ের ব্যবধানে মাওলানা আমকুনি সাহেব জামিয়া থেকে চলে গেলে এহ্তেমামের দায়িত্ব হযরতকেই নিতে হল। তিনি আমাকে তাঁর ‘নাইব’ হিসেবে মনোনীত করেন। প্রায় বিশ বছর এভাবেই চলল। যখন তিনি দুর্বল হয়ে গেলেন, তখন প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও নির্বাহী মুহতামিমের দায়িত্ব আমাকেই গ্রহণ করতে হল। এক পর্যায়ে তিনি আমার হাতেই তাঁর এ জামিয়া নামক অক্ষয় কীর্তি রেখে চলে গেলেন আপন মাওলার সান্নিধ্যে।
উহুদের যুদ্ধে হযরত আবু তালহা রাযি. রাসূল সা.এর সামনে নিজেকে পেশ করে দিয়েছিলেন, ফলে তাঁর সমস্ত শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাসূল সা.এর গায়ে একটি আঘাতও পড়তে দেননি।
জনৈক মহিলা স্বীয় স্বামী, ছেলে ও ভাইকে রাসূল সা.এর পরিবর্তে হত্যা করাকে বরণ করে নিয়েছিলেন, এসব কেবল দ্বীনের খাতিরেই হয়েছে।
বর্তমান যুগে এ হাদিসের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হযরত রাহ.। আর্থিক দৈন্যতা সত্ত্বেও দ্বীনের খাতিরে আপন স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে সকলকে ছেড়ে মাদরাসাকে অগ্রাধিকার দিতেন। সর্বদাই মাদরাসার চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। মাদরাসার জন্য বাড়ি-বাড়ি যেতেন এবং রাত্রিভর আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করতেন। বর্ধক্যজনিত কারণে একেবারেই দুর্বল, এমতাবস্থায় প্রচণ্ড কুয়াশা উপেক্ষা করে নদীর ঠাণ্ডা বাতাসের ভেতর দিয়ে নির্ভীক সৈনিকের মতো মাদরাসার জন্য নিজেকে বিসর্জন দিতেন। ঝড়-তুফান, শিলা-বৃষ্টি কোনোকিছুই তাঁর কাজে ব্যঘাত সৃষ্টি করতে পারত না।
একবার নদী ভাঙ্গনে মাদরাসা নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার উপক্রম হলে এলাকাবাসী অন্যত্র মাদরাসার বিল্ডিং নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ বিরাট ব্যায় নির্বাহের জন্য হযরতকে লন্ডন সফর করতে বাধ্য করে। তিনি লন্ডন সফর করেন। আমি গভীরভাবে লক্ষ্য করলাম, যে কেউ সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক সফর করলে ব্যক্তিগতভাবে অনেক হাদিয়া-তুহফার মালিক হন। আর তা অবৈধও নয়। কিন্তু লন্ডনে আমার আত্মীয়দের কাছ থেকে অবগত হলাম যে, হযরতের কাছে মাদরাসার অনুদান দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে কোন হাদিয়া দিলে তিনি তা গ্রহণ না করে বলতেন, আমি মাদরাসার কাজে মাদরাসার খরচে এখানে এসেছি। সুতরাং এ হাদিয়া গ্রহণ করা আমার জন্য উচিত নয়। আপনি তাও মাদরাসায় দিয়ে দেন। আরো লক্ষ্য করলাম, তিনি যে জুতো, টুপি-পাঞ্জাবি নিয়ে সফরে রাওয়ানা হয়েছিলেন, এসব পরেই মাদরাসায় ফিরলেন। ব্যক্তিগতভাবে কারো কিছু গ্রহণ করেননি। এভাবে বারবার সফর করেছেন। ইচ্ছে হলে বৈধ উপায়ে অনেককিছু করতে পারতেন। ছেলে-মেয়েদের জন্য অনেককিছু রেখে যেতে পারতেন।
পক্ষান্তরে দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারের কথা বললে উত্তরে বলতেন, আমি আল্লাহর কাজে ত্র“টি করছি। নতুবা আমি যদি আল্লাহর কাজ যথারীতি করতে পারি, তাহলে অবশ্যই আমার ও পরিবারের দায়িত্ব আল্লাহর হাতে রয়েছে। আল্লাহই সব করবেন।
এ ছাড়াও আমি যা দেখেছি বা পেয়েছি, সে হিসেবে আমার ধারণা, তিনি মাদরাসা তথা দ্বীনের ব্যাপারে এমন ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, যার উপমা অনুপস্থিত। দুয়া করি, আল্লাহ পাক আমাদেরকেও যেন তাঁর মতো দ্বীনের মকবুল খেদমতের তাওফিক দেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলার তাওফিক দেন এবং তাঁরই অক্লান্ত পরিশ্রম ও অশ্রুর ফসল এ জামিয়া যেন কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর দর্শনের উপর ঠিকিয়ে রাখেন। আমীন।