মোজাম্মেল হক
আচরণ একটি সার্বজনীন শব্দ। অর্থ, ব্যবহার, স্বভাব, চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব এবং স্বভাবজাত অভ্যাস। আচরণ সাধারণত দু’ধরনেরই হয়ে থাকে। উত্তম চরিত্র ও মন্দ চরিত্র। যে সব স্বভাব, চরিত্রের জন্য মানুষকে প্রশংসিত এবং উৎসাহিত করা হয়, তা উত্তম চরিত্র। আর যে সব স্বভাব, চরিত্রের জন্য মানুষকে তিরস্কৃত এবং নিন্দিত করা হয়, তা মন্দ চরিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
আল্লামা জুরজানি রাহ. বলেন, স্বভাবগত প্রশংসনীয় কার্যকলাপের নাম, সচ্চরিত্র আর স্বভাবগত মন্দ আচরণের নাম, মন্দ চরিত্র। উল্লেখ্য, মানুষের দু’এক দিনের আচরণ, তার স্বভাব বা চরিত্র হতে পারে না। বরং সচ্চরিত্র বা মন্দ চরিত্র তখনই বলা যাবে, যখন তা স্বভাবগতভাবে প্রকাশ পাবে। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ বিন সাইফুল্লাহ বলেন, আমরা বলি, অনিচ্ছকৃতভাবে যে সম্পদ ব্যয় করে, তাকে দানশীল বলা যাবে না। কারণ, এটা তার নিজস্ব স্বভাব নয়। মোটকথা, স্বভাবগত উত্তম ও প্রশংসনীয় চরিত্রের নাম হচ্ছে, উত্তম আচরণ এবং স্বভাবগত মন্দ চরিত্রের নাম হচ্ছে, মন্দ আচরণ।
রাসুল সা. বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যার চরিত্র সুন্দর’। ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূণাঙ্গতা দান করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছি’। রাসুল সা. ছিলেন, উত্তম চরিত্রের মহান আদর্শ। তার চরিত্রের প্রশংসা করে আল্লাহপাক বলেন, (অনুবাদ) ‘নিশ্চয় আপনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী’। এই পৃথিবীর বুকে সর্বাপেক্ষা উত্তম আচরণের একমাত্র অধিকারী ছিলেন, আমাদের রাসুল সা.। তিনি তাঁর উত্তম চরিত্র দিয়ে অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে আলোর পথে নিয়ে এসেছেন। আলোকিত রাজপথে হাজির করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন, উত্তম আচরণ ও সচ্চরিত্র। ফলে ২৩ বছরের মতো স্বল্পকালীন সময়ে বর্বর এক জাতিকে পরিণত করেছিলেন সোনার মানুষে। তাঁর তুলনা আজকের পৃথিবীতে নেই। তেমনিভাবে তাঁর হাতেগড়া একজন মানুষের মতো একজন মানুষ উপহার দিতে পুরো পৃথিবী আজ অক্ষম। ব্যর্থ। হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, কুরআন ছিলো- রাসুলের চরিত্র। কুরআন যেভাবে সুন্দর আচরণের নির্দেশ দিয়েছে, তিনি সেভাবে আচরণ করেছেন। ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, উত্তম চরিত্র মানেই হচ্ছে, কুরআন। আর ইসলাম মানেই হচ্ছে, উত্তম চরিত্র। সুতরাং ইসলামের অনুসারীরা হচ্ছে, উত্তম চরিত্রের অধিকারী। মুসলমানদের এই উত্তম আচরণের নজীর পৃথিবীর হরস্থানে রয়েছে; ঘরে, বাইরে, রাজপথে, গলিপথে, মাঠে, ময়দানে, ঈদগাহে, যুদ্ধে। এর প্রমাণ ইতিহাসে ভুরি ভুরি। মাত্র একটি ঘটনা শোনাই। খালিদ বিন ওলীদ রাযি.। মুসলিম মিল্লাতের অবিসংবাদিত বিজয়ী সেনাপতি। হাজার হাজার রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন। জয়ী হলেন। গ্রেপ্তার করলেন, অনেক পুরুষ এবং অনেক মহিলাকে। মহিলাদের মধ্যে একজন ছিলেন গর্ভবতী। খালিদ রাযি. তার কথা জানতে পেরে তাকে মুক্ত করতে নোটিশ জারি করেন। সাথে সাথে মহিলা মুক্ত হন এবং খালিদ রাযি. এর উত্তম আচরণের কারণে তিনি মুসলমান হয়ে যায়। ঐ মহিলার ইসলাম গ্রহণের পেছনে একমাত্র কারণ ছিল খালিদ রাযি. এর উত্তম আচরণ। পরবর্তীতে ঐ পরিবার থেকে জন্ম নেন মুসলিম মিল্লাতের আরেকজন অবিসংবাদিত বিজযী নেতা মুসা বিন নুসাইর রাহ.। বন্দিদের সাথে এটা ছিলো ইসলামের সাধারণ আচরণের মাত্র একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ। তাও অনেক পরের। এখান থেকেই বুঝে নিতে পারি, রাসুল সা. ও সাহাবাগণ বন্দিদের সাথে এবং অন্যান্য যেকোনো বিষয়ে যেকারো সাথে কোনপ্রকারের উত্তম আচরণ করেছেন! বন্দিদের সাথে ইসলামের এ মানবিকতা কতো তাৎপর্যমণ্ডিত, কতো মহান, তা অনুভব করা যায়, পাকিস্তানের ড. আফিয়া সিদ্দিকির সাথে তথাকথিত সভ্যতার ঠিকাদার সম্প্রদায়ের অমানবিক ব্যবহারের কাহিনি জানলে। আফিয়ার সাথে তাদের অমানবিক আচরণের কারণে পৃথিবীর সুন্দর ইতিহাস আজ কলঙ্কিত।
ইসলামবিদ্বেষী কুফরিশক্তি মুসলমানদের চারিত্রিক আদর্শের কাছে ব্যর্থ এবং পরাস্ত। ইসলাম ও মুসলমানের চারিত্রিক এ জয়, সেই প্রথম যুগ থেকে আজও চলমান। যুগে যুগে এর কাছে হার মেনেছে বস্তুজগতের শক্তি এবং পরাশক্তিগুলো। মুসলমানদের চারিত্রিক এই শক্তিতে আঘাত হানতে কুফরিশক্তি সর্বদা মরিয়া। এ বিষয়ে তাদের অপতৎপরতা সর্বদা অব্যাহত। এ অপতৎপরতা খুব সুক্ষ্ম। অনেক গভীর। আগ্রাসী এক স্রেুাত। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর ফাঁদ। আকাশ সংস্কৃতির অবাধ সয়লাব। ইসলামি চরিত্রে আগ্রাসনের নানার অপচেষ্টা রীতিমতো চরম হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে, তাদের এই ফাঁদে আজ পা দিয়েছে আমার আপানার অনেক ভাই-বোন। এর কাফ্ফারা দিতে হচ্ছে সম্মিলিত মুসলিমসমাজ। যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য ও ক্ষমাযোগ্য নয়। বিশ^মুসলিমের আজকের এই দুরবস্থার একমাত্র কারণ হচ্ছে, কুরআন ও সুন্নাহ ছেড়ে দেওয়া। আবার যদি পৃথিবীর দিকে দিকে ইসলাম ও মুসলমানের জয় জয়কার অবস্থা সৃষ্টি করতে হয়-তবে করণীয় একটাই, কুরআন-সুন্নাহে ফিরে যাওয়া। রাসুলের যে আদর্শ জাহিলিয়্যাত দূর করেছিল, সেই আদর্শে আবার গ্রহণ করা। ধনী, গরীব, ধর্ম ও বর্ণের ব্যবধান ভুলে গিয়ে, উত্তম আচরণের আদর্শকে আঁকড়ে ধরা। উঁচু করা। তাওফিক দান করুন, হে আল্লাহ!
লেখকপরিচিতি
শিক্ষক, জামেয়া ইসলামিয়া ফরিদাবাদ সিলেট