আন নাজাহ ছাত্রসংসদ
যোগ্যতা শুধুমাত্র কিতাবী পারদর্শিতার নাম নয়। যোগ্যতা একটি সার্বজনীন ও বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার উপযোগী উপস্থাপনার বিষয় এবং নাম। এতে কিতাবাদিতে পারদর্শিতার যেমন দখল রয়েছে, তেমনি রয়েছে বক্তৃতা, লেখনি, তর্ক, বিতর্ক, আচার, আচরণ ও উচ্চারণেরও বিরাট দখল। জামাতে জামাতে উস্তাযদের পাঠদানের মাধ্যমে ছাত্রদের কিতাবী যোগ্যতা তৈরি হয়। নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্ধারিত কিতাবের লেখনিচর্চা হয়। দারসের মাধ্যমে তৈরি হয় ছাত্রের মূল যোগ্যতা। কিন্তু বাকি থেকে যায়, মূল যোগ্যতা উপস্থাপনার মতো সহায়ক অন্যান্য আরো অনেক যোগ্যতা। অবশিষ্ট থেকে যায়, অজানা বিশ্বের অনেক কিছু। না জানা রয়ে যায়, সমাজজীবনে চলাচলের কলাকৌশল। অধরা থেকে যায়, সমাজপরিচালনার কলকব্জা। না জানা রয়ে যায়, সমাজসেবার কার্যত ভূমিকার পদ্ধতিসহ আরো অনেক কিছু। এ যোগ্যতার্জন একসময় (আকাবিরদের সময়ে) অনানুষ্ঠানিকভাবে অর্জন হওয়া সম্ভব হলেও সঙ্গত কারণে বর্তমানে আমাদের ছাত্রদের দিয়ে তা হচ্ছে না। একদিকে এসবকিছু হাতে কলমে জামাতে জামাতে শিখিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তা শিখতে হচ্ছে ছাত্রদের পারস্পরিক বন্ধন, আয়োজন করে দারসের ফাঁকে ফাঁেক। যাকে আমরা মূল যোগ্যতা বহিঃপ্রকাশের সহযোগী যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। বস্তুত এটি সহযোগী যোগ্যতা হলেও অনেক ক্ষেত্রে এও মূল যোগ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করতে হয়। সবমিলিয়ে এ যোগ্যতার্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। জামেয়ার ছাত্ররা সর্বপ্রকার যোগ্যতায় অভিজ্ঞ হওয়ার লক্ষ্যেই ১৪৩৬ হিজরি সনে তাদের জন্য গঠন করে দেয়া হয়েছে ‘আন-নাজাহ’- ছাত্রসংসদ। নির্ধারিত জিম্মাদার উস্তাযদের তত্ত্বাবধানে ছাত্ররা তাদের বক্তৃতা, লিখনিচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রসংসদের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে- সাপ্তাহিক/পাক্ষিক সভার আয়োজন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজসেবা, মাদরাসার বিভিন্ন বিষয়াদির প্রতি খেয়াল করা, উন্নয়নে ভূমিকা রাখা, অসহায়-দুর্বলের সেবায় এগিয়ে আসা, ইত্যাদি। নির্ধারিত সভাপতির তত্ত্বাবধানে জামাতবিভাগের ছাত্ররা সংসদগঠনের পর থেকেই নিয়মিত সভার কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। ১৪৩৮-৩৯ হিজরিতে ১১টি সাধারণ সভা ও একটি প্রাণবন্ত বার্ষিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছাত্রসংসদ সাপ্তাহিক ছোট কাগজ ও ছাত্রদের হাতেলেখা নির্বাচিত রোজনামচা প্রকাশের ধারাবাহিকতা প্রথম থেকেই অব্যাহত রেখে আসছে। এতে ছাত্রদের লেখাপড়ার পাশাপাশি বক্তৃতা দেয়া, প্রবন্ধ লেখা, মুকালামা করা, রচনাতৈরি ও পাঠচর্চা অব্যাহতভাবে চলছে এবং ছাত্ররা সার্বিক যোগ্যতা নিয়ে বড় হচ্ছে।

অভিভাবক সম্মেলন

ছাত্র-উস্তায ও অভিভাবকের যৌথ নাম হচ্ছে, মাদরাসা। দেশের যেকোনো মাদরাসার সাথে শতকরা ৫০-৫৫ জন অভিভাবকের সম্পর্ক রয়েছে। যে মাদরাসার সাথে অভিভাবকের সম্পর্ক যত বেশি জোরালো, সে মাদরাসার ছাত্ররা পড়ালেখার প্রতি ততো বেশি মনোযোগী, আগ্রহী এবং ঝামেলামুক্ত। যেহেতু সে ছাত্র, বয়স যতই হোক, তার মধ্যে চঞ্চলতা, সমস্যা, বিশৃঙ্খলা থাকবেই। তবে এগুলো কাটিয়ে উঠা যায়, যদি ছাত্রের সমস্যা জায়গামত সনাক্ত ও সমাধান করা হয়। এই জায়গামতো সনাক্ত ও সমাধান করতে গেলেই প্রয়োজন দেখা দেয় অভিভাবকের সাথে আলোচনা-পর্যালোচনার। এছাড়া ছাত্রের পড়াশোনার উন্নতি-অবনতির অনেক বিষয় অভিভাবকের সাথে সম্পৃক্ত। এ সববিষয়কে সামনে রেখে ছাত্রের পড়াশোনা উন্নত করতে গেলে মাদরাসাকর্তৃপক্ষ ও অভিভাবক সম্মেলনের বিকল্প নেই। জামেয়া তার বাচ্চাদের লেখাপড়ার উন্নতির জন্য বাৎসরে  তিনটি অভিভাবক সম্মেলন করে থাকে। যে কারণে আমরা আমাদের ছাত্রদের থেকে পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এমন জটিল কোনো সমস্যার  তেমন সম্মুখীন হই না। আশাকরি হবও না-ইনশাআল­াহ! এব্যাপারে আমরা বেশ সহযোগিতা পাচ্ছি স্বয়ং অভিভাবকদের কাছ থেকে। আমাদের প্রায় সকল অভিভাবকই জামেয়ার অভিভাবক সম্মেলনের প্রতি আন্তরিক এবং উৎসাহী।

শিক্ষাসফর

শিক্ষাসফর জ্ঞানার্জনে প্রভাববিস্তারকারী এক প্রচীন পদ্ধতি। হযরত আদম থেকে শুরু করে নবি মুহাম্মদ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম পর্যন্ত সবাই শিক্ষাসফর করেছেন। শিক্ষাসফর করেছেন সকল আহলে ইলম। খতিব বাগদাদি তাঁদের অন্যতম। ‘আর রিহল­াহ ফি তলবিল হাদিস’ এর জীবন্ত সাক্ষী। একা একা শিক্ষাসফর প্রাচীনযুগেও ছিল এখনো আছে। তবে সম্মিলিতভাবে শিক্ষাসফর প্রাচীনযুগেও কম এখনো কম। সম্মিলিতভাবে শিক্ষাসফরের গুরুত্ব যে দৃষ্টিকোণে গুরুত্বের এই সেই দৃষ্টিকোণেই উস্তায-ছাত্র ও অভিভাবক নিয়ে শিক্ষাসফর আরো বেশি গুরুত্বের। দেশের হাতেগোনা কয়েকটি সাধারণ কারিকুলামের প্রতিষ্ঠান এ ধরনের শিক্ষাসফরে অভ্যস্ত হলেও কওমিধারার মাদারিসগুলোর মধ্যে জামেয়া ইসলামিয়া ফরিদাবাদ সিলেটই প্রথম। প্রত্যেক বছরই সে তার এ শিক্ষাসফর চলমান রেখে আসছে। এতে ছাত্রদের বিনোদন, আনন্দ, ব্যায়াম, তিনপ্রজন্মের সাথে সফরের অভিজ্ঞতার্জন, প্রকৃতিপরিচিতির পাশাপাশি জানাশুনা হয় অনেক কিছু।

শিক্ষকপ্রশিক্ষণ

দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উস্তাদের পাঠদানের বিকল্প নেই। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন শিক্ষকের পাঠদান সাধারণ ১০জন শিক্ষকের পাঠদানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ও অনেক ফলপ্রসূ। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন শিক্ষকের হাতেই তৈরি হতে পারে দেশ ও জাতির সচেতন হাজারো তরুণ। শিক্ষকপ্রশিক্ষণের গুরুত্ব নানাবিধ কারণে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক হলেও মাদারিসে কওমিয়ায় আশাতীত নয়। ফলে তৈরি হচ্ছে না সচেতন কর্মীবাহিনী। গড়ে উঠছে না রিজাল তৈরির নীরব কাফেলা। শিক্ষকপ্রশিক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি জামেয়া ইসলামিয়া ফরিদাবাদ গুরুত্ব দিয়ে আসছে তার জন্মলগ্ন থেকেই। জামেয়ার নিজস্ব শিক্ষকদের নিয়ে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে পৃথক পৃথক প্রায় ১০টি প্রশিক্ষণ কর্মশালা। এছাড়া জামেয়া এবং বিভিন্ন মাদরাসার শতাধিক উদ্যমী, সচেতন উস্তায নিয়ে এ পর্যন্ত পশিক্ষণ কর্মশালা হয়েছে, মোট ৮টি। প্রত্যেকটিতে প্রশিক্ষক হিসিবে উপস্থিত ছিলেন, স্থানীয় ও জাতীয় আলোচকবৃন্দ। তাদের মধ্যে দারুল উলুম দেওবন্দের নাইবে মুহতামিম হযরত মাওলানা আবদুল খালিক সাম্বলি, দারুল উলুমের তাখাস্সুস ফিল হাদিসের উস্তায মাওলানা আবদুল­াহ মারুফি, মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন, প্রফেসর ড. নজরুল ইসলাম, প্রফেসর মোহাম্মদ মোয়াজ্জম হোসেন, ড. শামীম খান, ড. আবদুল­াহ আল মুমিন, বেফাকুল মাদারিসের প্রশিক্ষক মাওলানা এনামুল হক, ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির উপপরিচালক, মাওলানা শাহ নজরুল ইসলাম অন্যতম। জামেয়ার আয়োজনে এ প্রশিক্ষণ কর্মশালা থেকে প্রশিক্ষণার্থী অনেক উপকৃত হয়েছেন এবং কর্মক্ষেত্রে তারা অনেকের উপকারও করতে পরেছেন- বলে একাধিক অনুভূতি আমরা রেকর্ড করেছি। ফলে দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে শিক্ষকপ্রশিক্ষণ কর্মশালার চাহিদা। প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে বৃহৎ পরিসরে প্রশিক্ষণ কর্মশালার। জামেয়ার সীমিত পরিসরে কোনোভাবেই বৃহত্তর সিলেটবাসীর এ চাহিদাপূরণ সম্ভব নয়। আমরা মনে করি জামেয়া এ ধারা শুরু করেছে, এর সাথে এগিয়ে আসুক আরো প্রতিষ্ঠান, এগিয়ে অসুন আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এবং বোর্ডও। এক্ষেত্রে জামেয়া তার সর্বপ্রকার অভিজ্ঞতা দিয়ে এগিয়ে আসা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও বোর্ডকে সহযোগিতা করতে সদা প্রস্তুত রয়েছে- ইনশাআল­াহ।

দাওয়াত ও তাবলীগ

তালিম, তাজকিয়া ও তাহরিক- এর কাজ বিভিন্নভাবে জামেয়ায় চলমান। দাওয়াত ও  তাবলীগের সাথে জামেয়ার ছাত্ররা সক্রিয় এবং অভ্যস্ত হতে জামেয়া তার জামাতবিভাগের ছাত্রদের জন্য মাসিক ২৪ঘণ্টা, সবার জন্য সাপ্তাহিক গাশত, দৈনিক মাশওয়ারা ও তালিম, বাদ ফজর সম্মিলিত ইয়াসীন তেলাওয়াতসহ ইত্যাদির আমল বাধ্যতামূলক করে রেখেছে। এছাড়া সময় সুযোগে তিনদিন, রামাযানে চিল­া লাগানোর প্রতিও নিয়মতান্ত্রিক সবাইকে উৎসাহ দিয়ে আসছে।

 

কুতুবখানাবিভাগ

যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে হলে কুতুবখানা বা লাইব্রেরির গুরুত্ব অনেক। জামেয়া ধীরে ধীরে অন্যান্য বিষয় মোটামোটি গোছিয়ে আনার চেষ্টা করছে। বাকি আছে আরো কিছু বিষয়ের মতো কুতুবখানা বিভাগও। এ পর্যন্ত জামেয়ার নিজস্ব এবং উলে­খযোগ্য কোনো কিতাব নেই। ইচ্ছা আছে পর্যায়ক্রমে একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা গড়ে তোলার।

 

প্রকাশনাবিভাগ

প্রকাশনা বিভাগ জামেয়ার অন্যতম পরিকল্পনা। এ বিভাগের অধীনে একদল যোগ্য, দক্ষ, সচেতন, অভিজ্ঞ অনুবাদক, সঙ্কলক দিয়ে মৌলিক রচনা, অনুবাদ, ব্যাখ্যাগ্রন্থ, গবেষণাকর্ম আঞ্জাম দেয়ার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে। তাওফীকের মালিক একমাত্র আল­াহপাক।

আয়

জামেয়ার স্থাবর কোনো সম্পত্তি নেই। ছাত্রদের কাছ থেকে আসা মাসিক ফি হচ্ছে জামেয়ার

ব্যয়নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। এ ছাড়া সাধারণভাবে চাঁদা সংগ্রহের প্রচলিত কোনো নিয়ম আমাদের নেই। স্বেচ্ছায় কেউ কিছু দান করতে চাইলে তা যাচাই-বাচাই করে গ্রহণ করা হয়। এছাড়া কুরআনপ্রেমিক দেশি-বিদেশি কোনো ভাই কাউকে হাফিয বা আলিম বানাতে স্পন্সর করতে চাইলে সবার উপযুক্ততা, আলোচনা ও বিবেচনা-সাপেক্ষে তা মূল্যায়নের একটি ব্যবস্থা রয়েছে।

পরিকল্পনাসমূহ

১. প্রত্যেক বিভাগকে অত্যাধুনিক করা।

২. সমন্বিত সিলেবাস প্রণয়ন করা।

৩. সমৃদ্ধ একটি কুতুবখানা গড়ে তোলা।

৪. পৃথক পৃথক সেমিনার হল, পরীক্ষার হল, মেহমানখানা, দারুল মুতালা‘আ গড়ে তোলা।

৫. কেরাত, তাফসীর, হাদিস, ফিক্বহ, আরবি সাহিত্য, সারফ-নাহু, দাওয়াহ ও বাংলাসাহিত্য

বিষয়ে বিশেষ কোর্স চালু করা।

৬. জামেয়ায় নিজস্ব বহুতলবিশিষ্ট ভবণ ও মসজিদ নির্মাণ করা।