আবদুল কারীম: ১৪১৪ হিজরি। শিক্ষা জীবনের সর্বোচ্চ ক্লাসের ফাইন্যাল পরীক্ষার মাসাধিকাল দেরি। দাওরায়ে হাদিসের মসনদে শ্রদ্ধাস্পদ উস্তাদ শায়খ মরহুম আবদুল হাই রাহ. আগমন করলেন, বসে বললেন, তাঁর গ্রাম-সুপাতলা মসজিদের জন্য একজন হুঁশিয়ার ইমামের প্রয়োজন। আল্লাহর শুকরিয়া ক্লাসের সবাই এক বাক্যে আমি নগণ্যের নাম প্রস্তাব করল। তখন আমি ক্লাসে ছিলাম না, বিধায় আমার মতামত নিতে পারেন নি। আমার ইমামতির ইচ্ছা ছিল না; তাই প্রস্তাবটি রক্ষা করতে পারি নি। আহ্! তিনি যে মুস্তাজাবুদদাওয়াত ছিলেন তা আমি আগে বুঝে উঠতে পারিনি। এ বৎসরই রামাযানের পরপর লালারচক নাদিয়াতুল কুরআন ট্রেনিংক্যাম্পে আমার নিকট আবারো আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর জামে মসজিদে সানি ইমাম পোস্টে হযরতের সহকারী হিসাবে নিয়োগের জন্য খবর পাঠালেন। এখন আর কী করি। দ্রুত শ্রদ্ধেয় উস্তাদ মুফতি মুজিবুর রহমান সাহেবের সরণাপন্ন হই। তাঁরই পরামর্শে শায়খ আবদুল হাই রাহ.’র প্রস্তাব অনুযায়ী সানি ইমামের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হই। এ সুযোগে দীর্ঘ সাতটি বছর তাঁর সান্নিধ্য অর্জনের সুযোগ হয়। কিন্তু হুজুরের ইবাদত, ত্যাগ, আদর্শ তথা যাবতীয় গুণাবলি আমার জীবনে পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে না পেরে আমি বড়ই অনুতপ্ত, মর্মাহত।

কবির ভাষায় বলতে হয়—

“শত দুঃখও অনুতাপ, চোখের পলকে প্রিয়ার সঙ্গ শেষ হয়ে গেল।

তৃপ্তির সাথে ফুলের গন্ধ নিলাম না বসন্তকালের ইতি ঘটল।

শায়খ আবদুল হাই রাহ.‘র কাছে থাকার সুবাদে তার অনেক অমীয় বাণী শুনতে পেয়েছি। স্বচক্ষে দেখতে পেরেছি তাঁর বহু কারামাত, যা স্ব-বিস্তারে এ স্বল্প পরিসরে আমার পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। এরপরও কিছু কথা, কিছু অলৌকিক কাহিনী উপস্থাপন করছি।

একবারের ঘটনা

যা আমি কখনো ভুলতে পারব না। একদিন শেষ রাতে তাহাজ্জুদের সময় বাতের কারণে আমার হাত ও গর্দানে ব্যাথা করতে লাগল। শ্বাস বন্ধ হয়ে প্রায় মরণাপন্ন অবস্থায় ছটফট করছি। এরই মধ্যে হুজুর তাহাজ্জুদের নামাযের জন্য ওঠে ইস্তিঞ্জা করে যখন ওযু করতে আসেন তখন আমার কান্নার আওয়াজ শুনে বলছিলেন, কী হয়েছে মাওলানা আবদুল করিম? কী হয়েছে? তখন আমার কথা বলার শক্তিও ছিল না। খুবই কষ্ট করে প্রায় বেহুঁশ অবস্থায় দরজা খুলে দেই। আমার অবস্থা দেখে হুজুর রাহ. আমার গর্দান , হাত ও পিঠে নিজ হাত বুলিয়ে বললেন, আল্লাহ্ শিফা দিবেন। তারপর হারিকেন নিয়ে মসজিদের মুয়ায্যিন মাওলানা আবদুল্লাহর বাড়িতে চলে যান, মুয়ায্যিনকে ডাকেন, এতে তার খালাত ভাই মিনহাজ আসে। হুজুরের দুয়া ও কষ্টের ওসিলায় আল্লাহ আমাকে আরোগ্য দান করেন।

হুজুর আমাকে অত্যন্ত মহব্বত করতেন। আমাকে কেন? হুজুরের সাথে সম্পর্কিত প্রায় সকলেই এ কথার দাবিদার। ইহাই ছিল হুজুরের আদর্শ। আর এটাই আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর সুন্নাত।

আরেকটি অলৌকিক ঘটনা

হুজুর একবার বেশি অসুস্থতার কারণে সিলেট আয়শা মেডিকেয়ারে ভর্তি হন। আমার সাথে যোগাযোগ হয়েছে তবুও আমি সাময়িক অসুবিধায় সাথে সাথে আসতে পারিনি। মাদরাসার অন্য উস্তাদদেরকে পাঠিয়ে দেই। দু’দিন পর আমি ক্লিনিকে যাই এবং হুজুরের একান্ত পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলি, হুজুর আমাকে বদ দুয়া দিবেন না। আমাদের মাদরাসার আর্থিক সংকটের কারণে ব্যস্ত ছিলাম। দু’দিন হয়ে গেল আপনার সেবায় উপস্থিত হতে পারলাম না। হুজুর বললেন, “না ঠিক আছে। আসার দরকার নাই, দুয়া করিও মাদরাসার খেদমত এটাই আসল খেদমত।” তারপর দুয়ার সুরে হুজুর বললেন, আল্লাহ সাহায্য করবেন। হুজুরের একথার বরকতে দশদিনের ভিতর একাধারে প্রায় ৯/১০টি খাশি মাদরাসায় আসল। অথচ দু’মাসের মধ্যে গরু/খাশি কিছুই আসছিল না। অভাব দূর হয়ে গেল। হুজুরের দুয়ায় নগদ এ ফলাফল পেলাম। তখন থেকে এ পর্যন্ত  আমাদের মাদরাসার ফ্রিজ প্রায়ই মাছে গোশতে ভর্তি থাকে।

এ ঘটনার কিছুদিন পর আবার হুজুরের নিকট গিয়ে বললাম, হুজুর আপনার দুয়া নিয়ে আমাদের শাহ করার রাহ. জামিয়া হাফিজিয়া মাদরাসার বিল্ডিং এর কাজ আরম্ভ করেছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ! মাদরাসারতো অনেক কাজ হয়েছে, হুজুরকে একবার নেয়ার জন্য আমার মনে খুবই আশা ছিল। হুজুর সাথে সাথে বলে উঠলেন যে, আমি তো শাহকরার মাদরাসায় গিয়ে ঘুরে এসেছি। মাশাআল্লাহ মাদরাসাতো খুবই সুন্দর! ঠিক আছে, ঠিক আছে। একথা শুনে আমি প্রথমে মনে করেছি সত্যিই নাকি এসেছিলেন। পরে হুজুর মুচকি হাসি দিয়ে বললেন , আমি স্বপ্নে দেখেছি।

এরপর থেকে  আমার আরো দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে, এ মাদরাসার প্রতি হুজুরের আন্তরিক দুয়া রয়েছে। তার অনেক প্রমাণও আমরা পেয়েছি এবং পাচ্ছি, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।এর মধ্যে থেকে হল—আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তালিম বাংলাদেশ (কওমি মাদরাসা বোর্ড) এর বিগত ফাইন্যাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সকল মাদরাসাসমূহের মধ্যে যে বিভাগে ছাত্র ও মাদরাসা সবচেয়ে বেশি সে বিভাগে আমাদের শাহকরার মাদরাসা ১ম স্থান অধিকার করে বোর্ডে সুনামের অধিকারী হয়েছে। শুধু তাই নয়, পাশাপাশি ৩টি মুমতাজ ও ১টি বৃত্তি পেয়ে পুরো বোর্ডে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এটিই হল বুযূর্গদের নেক দৃষ্টির ফলাফ।

তাকওয়া ও আমানতদারীতে হুজুর ছিলেন প্রবাদতুল্য, যার কারণে এলাকার সকলের নিকট শতভাগ বিশ্বস্থ ও প্রশংসনীয় ছিলেন।

হুজুর একদিন কি এক প্রসঙ্গে নিজেই বললেন, মাদরাসার অনেক টাকাই আমার নিকট থাকে, কিন্তু আমি মনে করি এগুলি টাকা নয়, এগুলি পাথর। আমার পরীক্ষিত—অনেক দিন এরকমও হয়েছে যে, বাড়িতে যাব অথচ আমার নিকট ব্যক্তিগত কোনো টাকা নেই। আল্লাহর ওপর ভরসা করে বের হয়ে যাই। আল্লাহর শুকুর লঞ্চে উঠার সাথে সাথে একজন ভাড়া দিয়ে দিল। বৈরাগীবাজার যাওয়ার পর চিন্তা করলাম বিয়ানীবাজার গেলেতো আমাদের লাইব্রেরি আছে, টাকার অসুবিধা হবে না। কিন্তু লঞ্চ থেকে নামার আগেই এক ব্যক্তি ডাক দিয়ে বলল, হুজুর আসেন, আসেন গাড়িতে সিট আছে। ওঠার পর ওই লোক ভাড়া দিয়ে দিল, এরকম অনেক দিন হয়েছে।

হুজুর যে, একজন খাঁটি ওলি ছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের তখনকার উস্তাদ মাওলানা খালিদ আহমদ (রেঙ্গার হুজুর) বলেন, মরহুম মুহতামিম সাহেব রাহ. সহ একদিন আমরা অনেক রাত্রে সিলেট থেকে এসে খেয়া ঘাটে দেখি নদী পার হওয়ার জন্য কোনো নৌকা নেই।, ঠিক দক্ষিণ পারে মাওলানা শিহাবের বাড়ি, আমরা কয়েকজন মাওলানা শিহাব ও উনার ছোট ভাই আবদুল মুহাইমিনকে খুব জোরে জোরে ডাকছি কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছি না। হুজুর মাত্র একবার স্বাভাবিক আওয়াযে আবদুল মুহাইমিন বলে ডাক দিলে সাথে সাথে জবাব আসল, জি মউয়াজি। তখন নিঃসন্দেহে আমার বুজে আসল যে, এটা হুজুরের একটি কারামত।

হুজুর যে এত বড় বুযূর্গ ছিলেন এটা কাউকে বুঝতে দেননি। তিনি সর্বদা নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু আল্লাহ্ তায়ালা উনাকে এ জগত থেকে চিরবিদায় নেয়ার পর এমন কি জানাযার নামাযেরও পর কবর দেশে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে দেশ-বিদেশে উনাকে দাফনের ঘটনা দ্বারা এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন যা কখনো ভুলা যায় না।

আমিত্ব-বড়ত্ব বলতে উনার মধ্যে কিছুই ছিল না। ধৈর্য ও সহনশীলতা আল্লাহ্ পাক উনাকে খুবই দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকাসত্বেও যে কোনো সময় দেখতে গিয়ে শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করলে বলতেন- আলহামদুলিল্লাহ ভালো, কোনো সময় কোনো শেকায়াত করতে শুনিনি বা হা-হুতাশ করতে দেখিনি।

একেবারে শেষ দিকে যখন দেখতে যাই, হুজুরের শারীরিক অবস্থা দেখে খুবই আফসোস লাগত মনে করতাম আর হয়তো বেশি দিন হুজুরকে পাব না, তাই হুজুরের নিকট দুয়া চাইতাম। হুজুর বলতেন, ফি আমানিল্লাহ। আরো বলতেন কি নিয়া যাইতাম কিছুই তো করতে পালাম না, আমার জন্যও দুয়া করিও—মৃত্যুর সময় যেন কালিমা নসিব হয় কালিমার সাথে যেন মৃত্যুবরণ করতে পারি।

হুজুর শতরোগে আক্রান্ত হওয়া সত্বেও আমি কখনো সুন্নাতের বিপরীত কোনো কাজ করতে দেখিনি। বিশেষ করে চার জানু হয়ে বসে কোনদিন খানা খেতে দেখিনি। নামাযের মধ্যে সুন্নত কেরাত এবং মাসের উল্লেখ্যযোগ্য দিনসমূহের আমলের প্রতি খুবই যত্নবান ছিলেন।

মোটকথা সুন্নাতেরে ওপর চলাটা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। অসুস্থ অবস্থায়ও দেখেছি উনাকে নামাযে দাড়ানোর পর আর অসুস্থ বলে মনে হত না। ইহাই হল মুমিনের নামায। আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের মুরব্বী মুসল্লিগণ হুজুরের এবাদত বন্দেগীর ব্যাপারে বলেন যে, ইমাম সাহেব (মাওলানা আবদুল হাই রাহ.) যুবককালে অনেক বেশি এবাদত করেছেন; অথচ হুজুরের এ বৃদ্ধকালের এবাদত দেখেই ভয় করত—কারণ প্রচণ্ড গরম হউক আর হাড় কাঁপানো শীতই হউক না কেন কখনো শেষ রাত্রের তাহাজ্জুদ, যিকির, তিলাওয়াত, ইশরাক, চাশ্ত ও আউয়াবিন ছাড়তেন না বললেই চলে। প্রায়ই প্রতি বৎসরই এ’তেকাফ করতেন। একবার হুজুর এ’তেকাফ অবস্থায় কি এক প্রসঙ্গে বললেন, উনত্রিশ রামাযান সকালে কুরআন শরিফের খতম আরম্ভ করে ইফতারের পূর্বেই শেষ করেছেন। হুজুরের ইন্তেকালের দু’বৎসর পূর্বে হুজুরের বড় ছেলে মৌলবি হোসাইন আহমদ বললেন, এ বৎসর আব্বা রামাযানে কুরআনের ৯টি খতম দিয়েছেন। হুজুর দুয়ার সময় প্রায়ই বলতেন, আল্লাহ শুক্রবার নামাযের হালতে সিজদার অবস্থায় মৃত্যুদান করিও। আল্লাহ্ পাক তাঁর ডাক শুনে তাই করলেন।

পরিশেষে, আমি খুবই লজ্জিত যে, হযরত যত বড় মহান ব্যক্তিত্ব, সে তুলনায় আমার এ লেখাা কোনো রূপ মানায় না, তথাপি কাছে থেকে হুজুরের সান্নিধ্যে কটি বছর কাটিয়েছি বিধায় মনের আবেগে দু’কলম লেখেছি, হয়ত এ উসিলায় হযরতের সাথে জান্নাতে সাক্ষাত লাভ করতে পারব।

লেখক: ফাযিলে জামিয়া। মুহতামিম, শাহ করার রাহ. মাদরাসা, সিলেট