আবদুস সত্তার কাসিম: সাহাবায়ে কেরামদের আমরা দেখিনি। তাঁদের কথা পড়েছি ইতিহাসে। তাঁদের এখলাস লিল্লাহিয়াত, ত্যাগ-তিতিক্ষা-কুরবানি, আদর্শ, নিষ্ঠার কথা পড়ে বিস্ময়াভূত হয়েছি। এ কালে তাঁদের মতো মানুষ দুনিয়ার প্রতি, সম্পদের প্রতি, আড়ম্বরের প্রতি নিরাসক্ত নির্মোহ ব্যক্তিত্ব পাওয়া দুষ্কর। সেই অনুপম চরিত্রের মানুষগুলোর কথা আমার মানষপটে যেরূপে অঙ্কিত হয়েছে তাদের যে চিত্র, যে ছবি আমার মনে বারবার উঁকি দিচ্ছে—আমার পরম শ্রদ্ধেয় উস্তাদ মুরব্বি শায়খ মাওলানা আবদুল হাই রাহ. ছিলেন যেন তারই প্রতিচ্ছবি। তাঁর ছাত্র হিসাবে, তাঁর শিষ্য হিসাবে সুদীর্ঘ প্রায় ৪০ বৎসরের আমার যে অভিজ্ঞতা, সে অভিজ্ঞতার আলোকে আমি এ বিশেষণ ছাড়া তাঁকে অন্য কোনো বিশেষণে বিশেষায়িত করতে পারছি না।
সর্বকালের র্সবশ্রেষ্ঠ আদর্শ মহা-মানবের নাম আমরা সবাই জানি। তিনি আর কেউ নন—বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মাদ সা.। তাঁর মতো সুমহান ব্যক্তিত্বের আগমন তাঁর পূর্বে ঘটেনি পরেও আর ঘটবে না। তবে যুগ যুগান্তর শতাব্দী পেরিয়ে তাঁর সুমহান আদর্শের ধারক-বাহক হয়ে এ ধরাপৃষ্ঠে এমন কিছু ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের আগমন ঘটে, যাঁদের অুনপম ছোঁয়ায় পৃথিবীবাসী হয় ধন্য, জগদ্বাসী হয় বিমোহিত। অন্যদিকে কালের আবর্তনে পৃথিবীতে এমন মনীষীগণের আগমন ঘটে, যারা অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে, মনুষ্যত্ব, বিবেক প্রতিভার আলো দ্বারা দেশ-জাতি তথা বিশ্ববাসীকে আলোকিত করেন। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে যেসকল শিক্ষাবিদ গবেষক, লেখক, পণ্ডিত ও মনীষী তাঁদের বলিষ্ঠ অবদান দ্বারা শিক্ষা ও জ্ঞানের জগতকে উন্নত সোপানে উন্নীত করে আরো উদ্ভাসিত করেছেন; তাদের মধ্যে আমার মুহতারাম উস্তাদ, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শায়খ আবদুল হাই রাহ. অন্যতম। এ নশ্বর জগতের বুকে বিশিষ্ট বহু মানুষের আগমন ও প্রত্যাগমন ঘটেছে। তবে সকলের জন্য নাড়া পড়ে না মানব অন্তরে, সাড়া জাগে না জগত জুড়ে। সকলের ইন্তেকালেই আহাজারি করে না মানবকুল, সমুদয় মাখলুকাত, এমনকি আকাশ-বাতাস ও বি¯তৃত জমিন। এ কথাগুলোর সাক্ষী বিশ্বস্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামীনের বাণী- “কাফিরদের মৃত্যুতে আকাশ-বাতাস, জমিন ক্রন্দন করে না, কিন্তু মু’মিনের মৃত্যুতে আকাশ-বাতাস ক্রন্দন করে। (সূরায়ে দুখান- তাফসিরে জালালাইন পৃ.- ৪১১)। শুধু কি তাই? কারো কারো ইন্তিকালে মৃত্যু ঘটে গোটা বিশ্বের যেমন মহানবী সা. এর জবানিতে ইরশাদ হচ্ছে, موت العالم كموت العالم “একজন হাক্কানি আলিমের মৃত্যু যেন সমস্ত জগতেরই মৃত্যু”।
বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, পীরে কামিল, ওলীয়ে যামান শায়খ আবদুল হাই রাহ. গত ২৬ শে ফেব্র“য়ারি ২০১০ ইংরেজি রোজ শুক্রবার, আমাদেরকে শোক সাগরে ভাসিয়ে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন।
হযরত রাহ. ১৯৩২ ইংরেজি সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার থানার মাথিউরা গ্রামের এক সুশিক্ষিত সম্ভ্রান্ত, ঐতিহ্যবাহী আলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে জন্মসূত্রে বহুগুণ ও প্রতিভার অধিকারী এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নিজ গ্রাম মাথিউরা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন মাদরাসায় ভর্তি হন। ফারিগ হন লালবাগ থেকে। আল্লামা আবদুল হাই রাহ.‘র সম-সাময়িক ব্যক্তিবর্গের ভাষ্যমতে, তিনি ছোটবেলা থেকেই অসাধারণ মেধা ও অপ্রতিদ্বন্ধী প্রতিভার মালিক ছিলেন। তাঁর সুন্দর আচরণ, ছোটদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, বড়দের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাবোধই তাঁকে মর্যাদার আসনে উপবিষ্ঠ করে রেখেছে। তাঁর উস্তাদগণের একান্ত আশা ছিল যে, আমাদের আবদুল হাই হবে “শোহরায়ে আ’ফাক”। বাস্তবিক পক্ষে কর্মজীবনে এসে তাঁর উস্তাদগণের সেই আন্তরিক দুয়ার বদৌলতে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর সিলেট-এর গুরুত্বপূর্ণ মসনদে প্রায় ৩২ বৎসর অধিষ্ঠিত থাকার তাওফিক হয়েছে। তাঁর এই দীর্ঘ দিনের অক্লান্ত বিরামহীন, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের বদৌলতে জামিয়া ফলে-ফুলে শোভিত হয়ে এর সৌরভে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার আনাচে-কানাচে। তালিম-তারবিয়াত, ইতিহাস-ঐতিহ্য, চিন্তা-চেতনা, মাসলাক-মাশরাব ইত্যাদির ক্ষেত্রে সিলেট তথা বাংলাদশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মাদরাসা হিসাবে সর্বজনের সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছে। ফলে সারা দেশ থেকে মৌমাছিরা ইলমে ওহির মধু (ইলিম) আহরণের জন্য এখানে ভিড় জমিয়েছে।
তাঁরই আন্তরিক দুয়া, অক্লান্ত পরিশ্রম, বিরামহীন প্রচেষ্টা, মাওলানা শায়খ জিয়া উদ্দিন সাহেবের চিন্তাধারা ও দিক নির্দেশনায় এবং দেশী-বিদেশী দাতা ভাই-বোনদের সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতায় জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর আজ তার উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে। পালন করতে যাচ্ছে পঞ্চাশ বছর পূর্তি ও দস্তারবন্দী মহা সম্মেলন। আল্লাহ্ তায়ালা এই মহা সম্মেলনকে কবুল করুন। আদম আ. পৃথিবীর প্রথম মানব ও বনী আদমের আদি পিতা তাঁর পদভারে পৃথিবী পেয়েছিল প্রাণের স্পন্দন ও সজীবতা। তাঁর পথ ধরেই এসেছেন এ ধরায় অগণিত নবী ও রাসূল। সবশেষে এসেও যিনি সবার শীর্ষে, বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ্ তায়ালার নিজ তুলিতে অঙ্কিত—তিনি হলেন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা.। যাঁর গুণের নেই কোনো শেষ। দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের পরিধি যার বিশ্ব বিস্তৃত। যার পদচারণার সাক্ষী পৃথিবী, কামিয়াব আমরা উম্মাতে মুহাম্মদি। আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ সা. অক্লান্ত চেষ্টার মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন সাহাবায়ে কেরামের এক ঝাক সত্য-সৈনিক। যারা প্রত্যেকেই ছিলেন বহু গুণের অধিকারী। এভাবে তাবেয়িন, তবে তাবেয়িন তথা মহা মনীষীদের ধারা যুগ-যুগান্তর বয়ে চলে এসেছে আমাদের যুগ পর্যন্ত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় তাতে এসেছে দ্বিধা বিভক্তি। সঙ্কোচিত হচ্ছে আমাদের কর্মক্ষেত্র। হারাতে বসেছি সার্বজনীনতা। কিন্তু আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের কিছু খাঁটি প্রেমিক মুখলিস বান্দা সে ধারা অদ্যাবধি অক্ষুণ্ন রেখেছেন। সে ধারারই এক কালজয়ী ক্ষণজন্মা পুরুষ হলেন শায়খুল জামিয়া শায়খ আবদুল হাই রাহ.। শায়খ আবদুল হাই রাহ. একটি ইনকিলাবি নাম। একটি ইতিহাস। একটি নীরব ইলমি-আমলি তথা ফিকরি আন্দোলন। প্রায় এক শতাব্দীর ইতিহাসে সূর্যের প্রখরতার মতো বিশাল ব্যক্তিত্ব, চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর মতো কোমল আচার আচরণ, আর গোলাপ থেকে অধিক পবিত্র ও সুগন্ধিযুক্ত হৃদয়-মন, সবকিছু মিলে যেন তিনি এক ইনসানে কামিল (পরিপূর্ণ মানুষ)।
মানবতার সকল গুণ যেন এক সাথে ভিড় করেছিল এ মহান মানুষটির মধ্যে। জীবনের খণ্ডিত কোনো অংশ নয়; বরং পুরো জীবনটাকেই তিনি ঢেলে সাজিয়েছিলেন ইসলামের সুমহান শিক্ষায়, ইসলাম যে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ, তা তিনি জীবনের সকল কর্মে-কথায় কাজে আচার-আচরণে প্রমাণ করে গেছেন। চরমপন্থা, কিংবা শিথিলপন্থা নয়; বরং ইসলাম হল মধ্যপন্থা, সে কথাও তিনি প্রমাণ করে গেছেন জীবনের সকল শাখায়। “আত্মকেন্দ্রিকতার গণ্ডি থেকে মুক্ত হয়ে সমাজকেন্দ্রিক হতে হবে” ইসলামের এ আহবান ও খুঁজে পাই তাঁর পবিত্র জীবনে। শুধু পরকালই নয়, পরকালের পাশাপাশি ইহকালেও শান্তি ও মুক্তি দানের জন্য ইসলাম—এ মহান সত্যটিও প্রস্ফুটিত হয় তাঁর আদর্শ জীবনে। কর্মবিমুখতা নয়; বরং কর্মমুখী জীবন ইসলামি জিন্দেগির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ—এ সত্যটিও ফুটে ওঠেছে তাঁর কর্ম মুখর জীবনে।
মোটকথা ঈমান, ইয়াকিন, আমল-আখলাক, ইসলাম-ইহসান, তাকওয়- পরহেজগারি, ইবাদত-বন্দেগি, রিয়াযত-মুজাহাদা, আল্লাহর মুহাব্বত, মারিফাত, সততা-সত্যবাদিতা, প্রেম-ভালবাসা, øেহ-মমতা, তীক্ষ্ম বুদ্ধি, প্রচণ্ড মেধা, গভীর পাণ্ডিত্য, অপরিসীম সাহসিকতা, কর্মে অটলতা-অবিচলতা, সর্বক্ষেত্রে দারুণ বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, ধৈর্যশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা, পরোপকার, আতিথেয়তা, দয়া-দাক্ষিণ্য, উদারতা, কোমলতা, ন্যায়-ইনসাফ, সৃষ্টির সেবা, সমাজকেন্দ্রিকতা, কর্মমুখিতা, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম প্রভৃতি গুণাবলি তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছে মানবতার সুউচ্চ মাকামে। এজন্য তিনিই ছিলেন আসলাফ ও আকাবিরের বাস্তব নমুনা, আকাবিরে দেওবন্দের সঠিক উত্তরসূরি, শাহ ওলি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবির ভাবশিষ্য তরজমান।
ইলমের ময়দানে
সম্ভ্রান্ত ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবার জন্মগ্রহণকারী শায়খ আবদুল হাই রাহ. বাল্যবয়সেই পবিত্র কুরআন তাজবিদসহ তারতিলের সাথে পড়েন। প্রখর ধি-শক্তির অধিকারী আবদুল হাই রাহ. বাংলাদেশের প্রথমসারির একজন কারি ছিলেন। যিনি তারতিলের সাথে শ্র“তিমধুর কণ্ঠে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে আরবি লাহনে কুরআনের তিলাওয়াত করতেন। সাথে সাথে বিষয়ভিত্তিক আয়াতগুলো ধারাবাহিকভাবে তিলাওয়াত করে যেতে পারতেন। এটা তার ইলমে কিরাতের সাথে সাথে কুরআনের উপর অগাধ জ্ঞানেরও উজ্জ্বল সাক্ষর বহন করে। ইলমে দ্বীন অর্জনের জন্য স্থানীয় মক্তব, মাদরাসা, গাছবাড়ি আলিয়া মাদরাসা, দারুল উলুম দেউলগ্রাম, ঢাকার ঐতিহ্যবাহী লালবাগ, ভারতের বিশ্ব বিখ্যাত ইসলামি ইউনিভার্সিটি দারুল উলুম দেওবন্দে রীতিমত পড়াশুনা করেন। দেশ-বিদেশের নামি-দামি উলামা মাশায়েখ, মুফতি, মুহাদ্দিস এবং দার্শনিকদের সাহচর্যে থেকে লেখাপড়ার কারণে তিনিও হয়ে উঠেন পরবর্তী আলিম উলামাদের জন্য আলোর বাতিঘর। জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা শিহাবুদ্দীন সাহেব গোবিন্দশ্রী রাহ.। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্য অন্যতম ছিলেন শায়খ আবদুল হাই রাহ.। জামিয়া প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই তিনি সিনিয়র উস্তাদ ও ছদরুল মুদাররিসীন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাহ্যিক মুহতামিম ও জিম্মাদার ছিলেন আল্লামা শিহাবুদ্দীন রাহ. কিন্তু পরোক্ষ ও নির্বাহী জিম্মাদার হিসাবে সদা-সর্বদা যাবতীয় কাজ করে যাচ্ছিলেন আবদুল হাই রাহ.। তাঁরই আন্তরিক দুয়া, একান্ত পরামর্শ ও প্রস্তাবেই মাওলানা শায়খ জিয়া উদ্দিন (নাযিম সাহেব হুজুর)কে হাটাহাজারি মাদরাসা থেকে “নাযিমে তালিমাত” নির্বাচন করে জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর নিয়ে আসা হয়।
একদিন কথাপ্রসঙ্গে মুহতামিম সাহেব রাহ. বলেন, বাবা! “আবদুস সাত্তার কাসিম” শুনো! শুধু বিল্ডিংয়ের নাম মাদরাসা নয়; বরং তালিম-তারবিয়াত তথা তাযকিয়ায়ে নাফস (আত্মশুদ্ধি) এর সমন্বয়ের নাম হলো মাদরাসা। সুতরাং তালিম ও তারবিয়াতকে সুষ্ঠু-সুন্দর, সাবলীল, সার্বজনীন, কর্মমুখী করার জন্য একজন বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান সূক্ষদর্শী, কর্মতৎপর, বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী তীক্ষ্মজ্ঞানী, মেধাবী, পরিশ্রমী যুবক, মুহাক্কিক, তরুণ আলিমের প্রয়োজন। সুতরাং উল্লিখিত গুণাবলিগুলো পরিপূর্ণভাবে মাওলানা জিয়া উদ্দিন সাহেবের মধ্যে বিদ্যমান। তাকেই জামিয়া মাদানিয়ার নাযিমে তালিমাত হিসাবে আনা হউক। হযরত আবদুল হাই রাহ.-এর প্রস্তাবের সাথে সাথে তা বাস্তবে কার্যকর করা হল। সেই ১৩৮৮ হিজরি থেকে অদ্যাবধি ১৪৩২ হিজরি প্রায় ৪৮ বৎসর পর্যন্ত হযরত নাযিম সাহেব হুজুর উক্ত পদে বহাল আছেন। কালের আবর্তনে মাওলানা শফিকুল হক আমকুনি দা.এর ইহতেমামি যুগের পরে সেই ক্ষণজন্মা দূরদর্শী মাওলানা জিয়া উদ্দিন সাহেব হুজুরের পরামর্শেই দীর্ঘ কয়েক বৎসর প্রতীক্ষার পর কাক্সিক্ষত ও স্বপ্নে লালিত আপন উস্তাদ হযরত আবদুল হাই রাহ.কে মুসনাদে ইহতেমামে পেয়ে যারপরনাই খুশি হযরত নাযিম সাহেব। এবার শুরু হল আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদরাসার উন্নতির যাত্রা। আবদুল হাই রাহ. হাতে নিলেন জামিয়ার কাণ্ডারি, প্রধান সিপাহসালার হলেন হযরত নাযিম সাহেব। জামিয়ার কাণ্ডারি দূরদর্শী প্রধান সিপাহসালারের পরামর্শে ইলম ও আমল, তালিম ও তারবিয়াতের তরি নিয়ে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। উস্তাদ-শাগরিদের সুপরিকল্পিত প্ল্যান অনুযায়ী আল্লাহর মেহেরবানি তথা দেশবাসীর সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতায় খোলা হয় দাওরায়ে হাদিস (টাইটেল জামাত) ১৯৮৫ ইংরেজি সনে। শুরু থেকে অদ্যাবধি প্রায় আট শত উলামা মুফতি, মুহাদ্দিস, শায়খুল হাদিস ফারিগ হয়েছেন এ জামিয়া থেকে। তাঁরা দেশ-বিদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন দ্বীনে ইসলামের বিভিন্ন সেক্টরে। মসজিদ মাদরাসা, অফিস-আদালত, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন খেদমত ও পেশায় নিয়োজিত আছেন তারা। জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর আজ ফলে ফুলে-রসে সুগন্ধিতে ভরে ওঠেছে।
প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তিনি ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরে জামে মসজিদে। সমস্ত এলাকাবাসী তাঁকে সাধারণত “ইমাম সাহেব হুজুর” হিসাবে জানে এবং চিনে। এই নামে তিনি এতটাই পরিচিত হয়ে উঠেন যে, ‘ইমাম সাহেব’ যেন তাঁর আসল নামে পরিণত হয়ে যায়। অনেকেই তাঁর মূল নাম জানে না।
১৯৭৮ সালে ইহতেমামের দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁর নেশা হয়ে যায় মাদরাসার সার্বিক উন্নতি। তিনি একজন সুদক্ষ, দূরদর্শী, তীক্ষ্ম জ্ঞানসম্পন্ন, বিচক্ষণ মুহতামিম ছিলেন। তিনি খুব ভালো করে জানতেন যে, একটি প্রতিষ্ঠান কিভাবে গড়ে উঠানো যায়। তাঁর হাতের মুঠোয় ছিল প্রতিষ্ঠানের সুনাম সুখ্যাতি ছড়ানোরসমূহ উপকরণ। যার কালজয়ী সাক্ষী জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর। তাঁর পাঠদান পদ্ধতি ছিল অপূর্ব, অতুলনীয়। এককথায় তিনি ছিলেন ছাত্র গড়ার সুদক্ষ কারিগর। এ কথা তাঁরই হাতেগড়া শত-সহস্র হাফিয, আলিম, মাওলানা, মুফতি, মুহাদ্দিস, মুহতামিম, নাযিম, শায়খুল হাদিসগণ প্রতিনিয়ত ঘোষণা করে যাচ্ছেন। সুদীর্ঘ ৪০ বৎসরের ইহতেমামির জীবনে হযরতের খেয়াল ছিল না আয়েশ-আরামের প্রতি, ধন সম্পদের প্রতি, বিরাম-বিশ্রামের প্রতি এমনকি নিজ পরিবার-পরিজনদের প্রতি, নিজের স্বাস্থ্যের প্রতিও। উৎসর্গ করা কাকে বলে, আক্ষরিক অর্থেই তিনি নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন জামিয়া মাদানিয়ার খেদমতে। তাঁর ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, যোগ্যতা-প্রতিভা,মেধা, জ্ঞান-বুদ্ধি, সময়-জিন্দেগি সবকিছুই উজাড় করে দিয়েছিলেন জামিয়ার উন্নতিকল্পে। নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়াই ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। “হয় মন্ত্রের সাধণ, নয় শরীর পতন” এর বাস্তব উদাহরণ হযরত আবদুল হাই রাহ.। আর এর সবকিছুই ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তাঁর সবকিছুতেই ছিল লিল্লাহিয়াত। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর জন্য। তিনি সবসময় বলতেন, মুসলমান তার জীবনের সকল কাজ করবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে। তার লক্ষ্য হবে আখিরাত; দুনিয়া নয়। দুনিয়াকেও ব্যবহার করবে এই লক্ষ্যে পৌঁছার সহায়ক বস্তু হিসাবে। তিনি ছিলেন মাওলানা রূমীর ভাবশিষ্য ও মসনবি শরিফের অনুরাগী পাঠক। তিনি তাঁর ফার্সি বয়াত উল্লেখ করে বলতেন—“পানির উপর দিয়েই নৌকা চালাতে হয়, কিন্তু পানি থাকতে হয় নৌকার তলদেশে।” লক্ষ্য রাখতে হবে নৌকার ভিতরে যেন পানি প্রবেশ না করতে পারে। কারণ পানি নৌকার ভিতরে প্রবেশ করলেই নৌকা হবে ধ্বংস। তেমিন দুনিয়ার উপর দিয়েই পাড়ি জমাবে তুমি আখেরাতের বন্দরের দিকে। দুনিয়া তোমার পদতলে থাকবে। দুনিয়ার মোহ-আসক্তি যদি তোমার ভেতর প্রবেশ করে তবে তোমার ধ্বংস অনিবার্য। এ কথা শুধু তিনি মুখেই বলতেন না; বরং তাঁর প্রতিটি কাজ-কর্ম তথা যাবতীয় তৎপরতা থেকে প্রকাশ পেত লিল্লাহিয়াত। তিনি ছিলেন লিল্লাহিয়াতের মূর্তপ্রতীক।
তাঁর জীবনের বিশেষ কিছু দিক
এখলাস: এখলাস তথা সকল কাজ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা এই এখলাস-ই তাসাওউফের প্রথম ও প্রধান মাকাম। মূলত এখলাসই হল ইসলামের প্রাণ। যেহেতু তাসাওউফের মূল শিক্ষা ও উদ্দেশ্যই-ই হল গায়রুল্লাহ তথা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য সবকিছু থেকে বান্দার দিল মুক্ত করে আল্লাহ তায়ালার দিকে মনোনিবেশ করা। আর এরই অপর নাম এখলাস।
এবারে আসুন, আমরা দেখি হযরত আবদুল হাই রাহ.’র জীবনে এখলাসের দখল কতটা ছিল? প্রথমেই বলে নেই যে, আমাদের মতো অযোগ্য ও দুর্বলদের পক্ষে এতো বড় মুখলিসের এখলাসের মাত্রা ও পরিধি নিরূপণ করতে যাওয়া এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র। তবে আমাদের দুর্বল ও বাহ্যিক চোখে যতটুকু ধরা পড়ে—তার খানিকটা প্রকাশের চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। মূলত আবদুল হাই রাহ. এর পুরো জীবনের ভিত্তিই হল এখলাস। এই এখলাসের বরকতেই তাঁর জীবন এতটা বরকতময়, এতটা মর্যাদাপূর্ণ। তাঁর পবিত্র জীবনের এখলাসে ভরা অসংখ্য ঘটনাবলি থেকে এখানে আমি মাত্র দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করব।
ক. ১৮৮০ ইংরেজি সালে শরহে জামির বছর হযরতের কাছে আমাদের বালাগতের কিতাব-তালখিসুল মিফতাহর ঘণ্টা ছিল। কোন একদিন হঠাৎ দারসে এখলাসের প্রসঙ্গ এসে গেল। হযরত আমাদেরকে তার সংজ্ঞা ও পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের যার-যা জানা ছিল তাই খুলে বললাম। হযরত তা শুনে খুশি হয়ে বললেন, বেটা! আবদুস সাত্তার! এখলাস সম্পর্কে বেশ ভলোই বলেছ, তবে শুনো, এখলাসের আরও একটা নিগূঢ় তথ্য আছে, সেটা তোমার জেনে রাখা ভালো, ভবিষ্যতে কাজে আসবে নিশ্চয়। তা হল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো বিনিময়-প্রতিদান ছাড়া নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোনো কাজ করার নাম হল এখলাস। মাখলুক থেকে কেনো বিনিময় চাওয়া পাওয়া এখলাসের পরিপন্থী। কাজের বিনিময়-প্রতিদান চাওয়া পাওয়া হবে একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালার কাছে। কাজ করতে হবে দুনিয়ায়, ফলাফল আসবে আখিরাতে। এটাই এখলাস। হযরত আবদুল হাই রাহ. এখলাসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আরও বলেন, অনেক সময় কাজের ভালো বিনিময়ের পরিবর্তে প্রতিকূল অবস্থা, খারাপ ব্যবহার, অশালীন আচার-আচরণ, অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ, অশ্লীল কথা-বার্তা, দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদি দেওয়া হবে জেনেও তার সাথে ভালো ব্যবহার করারই নাম এখলাস। অর্থাৎ যাকে তুমি পড়াবে, সেই তোমাকে চড়াবে। যাকেই তুমি তোষামোদ করবে, সেই তোমাকে শত্র“ ভাববে, যাকেই তুমি কিছু খাওয়াবে বা দেবে বা লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবে, সে-ই একদিন তুমার চরম ক্ষতি করবে। এই নেগেটিভ বিষয়গুলো চিন্তা করে বিনিময় ছাড়া কাজ করার নাম এখলাস। কাজের বিনিময়, প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা পাওয়াতো দূরের কথা, তার পরিবর্তে হাজারো দোষ-ত্র“টি, বদনাম, অপবাদ, কলঙ্ক ঘাড়ে নিয়ে আসতে হবে—এটার নামই এখলাস, লিল্লাহিয়াত।
লক্ষ্য করো, নবী-রাসূলরা তাঁদের কাওমের সাথে কেমন এখলাসপূর্ণ ব্যবহার করেছেন—আর কাওমের লোকেরা কেমন দুর্ব্যবহার করেছে। এ জন্যেই কুরআনে করীমে বলা হয়েছে, وما أمرو إلا ليعبدوا الله مخلصين له الدين প্রত্যেক নবী এবং রাসূলকে মুখলিসভাবে দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলিগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা.-এর দিকে তাকান—তিনি মক্কা তথা আরববাসীর সাথে কিরূপ এখলাসপূর্ণ ভালো, সুন্দর ও উন্নত ব্যবহার করেছিলেন। আর তারা রাসূল সা.-এর সাথে কেমন খারাপ ব্যবহার করেছিল। এজন্যই হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, والمخلصون على خطر عظيم এখলাসের এই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে সামনে রাখলে ছোট বড় কারো মনে কোনো দুঃখ-বেদনা ও অনুশোচনা কিছুই থাকবে না।
হযরতের ভিতরে এরকম এখলাসের পাহাড় ছিল। এমন এখলাস নিয়ে তিনি জীবন পরিচালনা করেছেন—পরিচালনা করেছেন তিনি মসজিদ-মদরাসা, ছাত্র-শিক্ষক, পরিবার-পরিজন, দেশ-সমাজ ও জাতি। এখানেই নিহিত আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদরাসার উন্নতির চাবিকাটি।
খ. ১৯৮৩ সালে মাদরাসার বাৎসরিক জলসার সময় জামিয়ার বাৎসরিক রিপোর্ট পেশ করার কিছুদিন পূর্বে অফিসে শায়খ আবদুল হাই রাহ.এবং হিসাব রক্ষক মাস্টার শফিক সাহেব প্রমুখ কয়েকদিন চেষ্টা করার পরও এক পয়সার হিসাব মিলাতে পারছেন না। তিন দিন পর শফিক স্যার বললেন, হুজুর! অনেক পরিশ্রম করলাম, তার পরেও এক পয়সার হিসাব মিলাতে পারছি না; ঠিক আছে, আমি এক পয়সার বিনিময়ে আমার পকেট থেকে এক টাকা মাদরাসার তহবিলে জমা দিয়ে দিব। হযরত একথা শুনে রাগান্বিত হয়ে বললেন, জনাব মাস্টার সাহেব! এটার নাম আমানতদারি নয়। আপনি এক পয়সার বিনিময়ে এক টাকা দিতে পারবেন—আমি কি তা দিতে পারবো না? আপনি একি কথা বললেন! আপনার মতো লোকের কাছে হিসাব না রাখাই ভালো। আপনি আগামীতে আমার মাদরাসার এই পদে না থাকাই উচিত। পরে হযরত বললেন, দেখুন! এক পয়সার হিসাব মিলাতেই হবে। যাক শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কোনো এক বান্দার মাধ্যমে তার সমাধান হয়ে গেল। হযরত তার শুকরিয়া আদায় করলেন। এটাই ছিল তাঁর এখলাস ও আমানতদারির নিদর্শন। এরকম খালিস, মুখলিস, আল্লাহভীরু আমানতদার মুহতামিম ও জিম্মাদার পাওয়া খুবই বিরল ও দুষ্কর।
ইহ্সান
ইহসান হল তাসাওউফের এক অতি উঁচু মাকাম। প্রসিদ্ধ হাদিসে জিবরিলে হযরত জিবরিল আ.-এর প্রশ্নের উত্তরে রাসূল সা. ইহসানের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ইহসান হল—তুমি আল্লাহ্ তায়ালার ইবাদত-বন্দেগি এমনভাবে করবে, যেন তুমি আল্লাহ্ তায়ালাকে দেখছ, আর যদি তাকে দেখতে না পাও, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি তোমাকে দেখছেন।
মূলত একজন মুমিনের পুরো জীবনটাই ইবাদতের জীবন। তাহলে হাদিসের আলোকে ইহসানের অর্থ দাঁড়ায়—জীবনের সকল কাজ-কর্ম এমন হবে যা আল্লাহকে দেখে করা যায়। কিংবা আল্লাহ তায়ালা দেখছেন এই অবস্থায়ও করা যায়।
হযরত আবদুল হাই রাহ.-এর সকল কথা, কাজ, আচার-আচরণ এই ইহসানেরই বাস্তব নমুনা ছিল। হযরতকে যারা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন, তাঁর ইবাদত বন্দেগিতে কী পরিমাণ একাগ্রতা ছিল। তাঁর নিষ্ঠা ও একাগ্রতা প্রমাণ করে যে, তিনি এমনভাবে ইবাদত করতেন, যেন তিনি আল্লাহ তায়ালাকে দেখে দেখে ইবাদত করছেন। তাঁর ওযু, নামায, গভীর রাত্রের তাহাজ্জুদ, যিকির, ফিকির, তিলাওয়াত সবকিছুতেই ছিল সুগভীর ইহসানের ছাপ। আর এই ইহসানের কারণেই ইবাদতের দাম ও মান বেড়ে যায় লক্ষ্য গুণ।
মোটকথা- জীবনের সকল কর্মে জবাবদিহীতার প্রচণ্ড চিন্তা সবসময় তাকে ঘিরে রাখত। তিনি শুধু সেসব কাজই করতেন, যা আল্লাহকে দেখিয়ে করা যায়। ইহসানের কী উঁচু মাকামে তিনি অবস্থান করছিলেন তা আমাদের পক্ষে অনুমান করাও কঠিন।
দুই. আল্লাহ তায়ালার মুহাব্বত ও মারিফত
সকল কাজ কেবল, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য করা এবং আল্লাহকে যেন দেখে দেখে করা, এই এখলাস ও ইহসানের পাশাপাশি আরেকটি বিষয় তাসাওউফের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তা হল আল্লাহ তায়ালার মহব্বত ও মারিফত লাভ। কুরআনে করিমে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘মুমিনরাই’ আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে’।অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি জ্বিন ও মানবজাতিকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। তাই আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি মুহাব্বত করা ও তাঁকে গভীরভাবে জানা ও চেনার চেষ্টা করা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এই বিষয়টিতেও শায়খ আবদুল হাই রাহ.-এর মাকাম ছিল অতি উচুঁতে। আল্লাহ প্রেমের কত গভীরে তিনি প্রবেশ করেছিলেন তা অনুমান করতে আমরা অপারগ। আল্লাহর মহব্বতের আধিক্য তাঁকে এমনভাবে পেয়ে বসত, যে কোনো সময় নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেলতেন। আল্লাহপ্রেমে আত্মহারা হওয়া কখনও রূপ নিত জযবায়। কখনও পৌঁছাত ফানা’র মাকামে, কখনো আবার বাকা’র মাকাকে।
আল্লাহর ওলীদের কখনো আল্লাহর দিকে রূহানি উরুজ বা আত্মিক ঊর্ধ্বগমন হতে থাকে, একে ফানা (فنا) বলে। আবার মানবজাতির কল্যাণে তাঁদের নুযুল অবতরণ হতে থাকে, যাতে তাঁরা মানুষের মাঝে কাজ করতে পারেন, মানুষকে আল্লাহর সাথে জুড়ে দিতে পারেন। এই দ্বিতীয় অবস্থাকে (بقا) বাকা বলে। হযরত আবদুল হাই রাহ.-এর মধ্যে ফানা ও বাকার দারুণ সমন্বয় ছিল। একদিকে আল্লাহর প্রেমে (মুহাব্বতে) বিভোর থাকতেন, অপরদিকে দেশ-জাতি ও সমাজ নিয়ে ভাবতেন। মানব জাতির দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণ সাধনে সদা সচেষ্ট থাকতেন।
আল্লাহর মহব্বতের অতিশয্যে যখন তাঁর জযবা (আল্লাহর দিকে গভীর আকর্ষণ) উঠত—তখন যে কত রাত নির্ঘুম কাঠাতেন, কত মাইল যে পায়ে হেটে অতিক্রম করতেন, কত ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিনের পর দিন যে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ অব্যাহত রাখতেন, আর আল্লাহর মহব্বতে অধীর হয়ে কত যে হামদ-সালাত ও সালাম পাঠ করতেন, তা মনে করলেও গাঁ শিউরে ওঠে। তা না দেখলে দূর থেকে বুঝা যাবে না, কল্পনাও করা যাবে না। সাথীরা-ছাত্ররা প্রায়ই দুর্বল হয়ে পড়ত, কখনো সবাই অচল হয়ে পড়ত, কিন্তু হযরত রাহ.-এর গতি অবিরাম অব্যাহত থাকত। রাত গভীর হলেই তাহাজ্জুদে দাঁড়াতেন। তখন খোদা প্রেমের কী যে এক পরিবেশ সৃষ্টি হত—আল্লাহ-ই ভালো জানেন।
তিন. নিজেকে মিটানো
নিজকে মিটানো, নিজের আমিত্ব-অহংকারকে পিষে ফেলা ইসলামের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। একবার আল্লামা সোলাইমান নদবি রাহ. হাকিমুল উম্মত হযরত থানবি রাহ.কে প্রশ্ন করেছিলেন যে, তাসাওউফ কোন জিনিসের নাম?
তখন উত্তরে হযরত থানবি রাহ. বলেছিলেন, তাসাওউফ হল নিজেকে মিটানোর নাম। নিজকে এতটা মিটানো যে, এই খেয়ালও না করা যে, আমি নিজেকে মিটিয়েছি। ঘুমন্ত ব্যক্তির যেমন নিজ ঘুম সম্পর্কে কোনো খেয়াল থাকে না, ঠিক তদ্রুপ সেই ব্যক্তিই নিজকে মিটাতে সক্ষম হয়েছে, যার এই মিটানো সম্পর্কেও কোনো খেয়াল থাকে না। আর এরূপ নিজেকে মিটানো যার নসিব হয়ে যায়, আল্লাহ তায়ালা তার মর্যাদা বহু গুণ উচুঁ করে দেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, من تواضع لله رفعه الله “যে আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বন করে তথা নিজকে মিটিয়ে দেয়, আল্লাহ্ তায়ালা তার মর্যাদা বুলন্দ করে দেন”।
হযরত আবদুল হাই রাহ.-এর মাঝে এই বিনয় তথা নিজকে মিটানোর মাত্রা এতো বেশি ছিল যে, কাছ থেকে না দেখলে তা কল্পনা করাও কঠিন।
অনেক সময় বিভিন্ন মহলে এমনভাবে চুপ থাকতেন, তখন বিশাল জনসমুদ্রের এই আধ্যাত্মিক মনীষীকে মনে হতো না যে, তিনি কিছু জানেন। কোনো মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি মুফতি সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। হাদিস সংক্রান্ত বিষয় হলে শায়খুল হাদিস সাহেবের কাছে পাঠাতেন; মাদরাসার তালিম-তারবিয়ত সংক্রান্ত বিষয় হলে নাযিম সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। অথচ এসব বিষয় সম্পর্কেই তাঁর ছিল অতি উঁচু মাত্রার জ্ঞান। কোনো কোনো সময় জযবার হালতে প্রকাশ পেত হযরতের ইলমি মাকাম।
অন্যদিকে তিনি দুঃখীর দুঃখ মোচনে সবার অগ্রগামী থাকতেন; অভাবীর অভাব মিটাতে সদা ব্যস্ত থাকতেন; সাহায্যপ্রার্থীর সাহায্যে হযরত-ই সকলের আগে থাকতেন। সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য শায়খ ছিলেন স্নেহময়ী মায়ের কোলের মতো এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তিনি সকলের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সমস্যা সমাধানে সর্বাত্মক আন্তরিক চেষ্টা করতেন। এমনই মাটির মানুষ ছিলেন হযরত আবদুল হাই রাহ.। কিন্তু নিজেকে মিটানোর এই গুণ কখনো তাঁর মধ্যে ভীরুতা ও কাপুরুষতা সৃষ্টি করতে পারেনি। যে কোনো অন্যায়-অসত্য আর দূর্নীতির বিরুদ্ধে সময়মত জ্বলে উঠতেন সিংহপুরুষ হয়ে। এসবের মুলোৎপাটনে বা প্রতিকারে অপরিসীম সাহস নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন ময়দানে।
ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাহ.-এর চরিত্রের যেন প্রতিচ্ছবি ছিলেন হযরত আবদুল হাই বাহ.; যার মধ্যে নম্রতা ও সৎ সাহস সমানভাবে বিরাজ করত। প্রচারবিমুখ এই মনীষী আমাদের মাঝে নিজকে মিটানোর এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন চিরদিন।
পাঁচ. খেদমতে খাল্ক (সৃষ্টির সেবা)
খেদমতে খাল্ক বা সৃষ্টির সেবা, ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাওলানা রূমি রাহ. বলেন, তাসাওউফ সৃষ্টির সেবা ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধু তাসবিহ, সিজদা আর জায়নামাযে পড়ে থাকার নাম তাসাওউফ নয়। রাসুল সা. বলেছেন, গোটা সৃষ্টি আল্লাহর সংসার সদৃশ। তাই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় বান্দা সেই, যে আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া করে। হযরত আবদুল হাই রাহ. সৃষ্টির প্রতি এতটা দয়ালু ছিলেন যে, কেউ যদি কোনো কুকুরকে ঢিল বা পানি ছুড়ে মারত, তাতে হযরত খুবই রাগ করতেন এবং শক্তভাবে নিষেধ করতেন।
গরু-ছাগল, কুকুর আর পিপিলিকার মতো ক্ষুদ্র প্রাণীর প্রতি যার এত দরদ আশরাফুল মাখলুকাত মানবজাতির প্রতি তাঁর কেমন দরদ—তা সহজেই অনুমেয়। যে কোনো দুঃখী-অভাবীর অভাবে, বিপদগ্রস্তের বিপদে তাঁর কোমল মন কেঁদে উঠত। সামর্থানুযায়ী সবধরনের সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। শত্র“কে তিনি ক্ষমা করে দিতেন। শুধু ক্ষমাই নয়, সাধ্য মতো সাহায্য-সহযোগিতাও করতেন। এ ব্যাপারে তাঁর অনেক ঘটনাবলি বিদ্যমান।
ছয়. যুহদ ও কানায়াত (সংসারাসক্ত না হওয়া ও অল্পে তুষ্টি হওয়া)
হযরত আবদুল হাই রাহ.-এর মাঝে এ উভয় গুণ ছিল উচ্চ মাত্রায়। প্রায় সারাটা জীবন ছোট একটা পুরাতন ঘরে কাটিয়ে দিয়েছেন। দুনিয়ার আয়েশ-আরাম, ধন-দৌলত,গাড়ি-বাড়ি তথা সম্পদের কোনো মোহ তাকে কখনও স্পর্শ করে নি।
দেউলগ্রাম ও আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদরাসায় শিক্ষকতার শুরু জীবনে মাত্র সামান্য টাকা মাসিক সম্মানী ভাতা পেতেন। তা থেকে কিছু টাকা নিজের সংসারে, কিছু টাকা আব্বার যৌথ সংসারে ভাইদের লেখাপড়ার কাজে খরচ করতেন। এত অল্প টাকা মাসিক আয়, কিন্তু দুই তিন খাতে খরচ! এতৎসত্ত্বেও কোনো অভিযোগ নেই, কোনো অনুযোগ নেই, নেই কোনো বেতন বৃদ্ধির আবেদন; বরং কোনো এক মিটিংয়ে শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির আলোচনা প্রসঙ্গে আবেগে কেঁদে ফেললেন, আর বললেন, বেতনের জন্য মাদরাসায় পড়াতে আসিনি; বরং আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এখানে এসেছি।
জামিয়ার মুসনাদে বসার পর থেকেই হযরত শায়খ আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর এলাকা তথা দেশবাসীর কাছে মাদরাসার কথা বলতেন। তার উন্নতির জন্য টাকা-পয়সা, ইট-বালু, রড-সিমেন্ট ইত্যাদির কথা বলতেন। কিন্তু এই বলাটা তাঁর নিজের ফ্যামিলির জন্য ছিল না; বরং দ্বীনের জন্য ছিল। মসজিদ-মাদরাসার জন্য ছিল। জামিয়ার গরিব, ইয়াতিম, অসহায়, দুঃখী ছাত্রদের সাহায্যের জন্য ছিল, আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ ও রাসূলের মেহমানদের জন্য ছিল। হযরতের চাওয়া-পাওয়ার সবকিছুই ছিল অন্যের জন্য; নিজের জন্য ছিল না।
তার প্রমাণ- মাদরাসার প্রয়োজনে হযরত প্রায় ৩-৪ বার লন্ডন সফর করেছেন। লন্ডন প্রবাসী ভাই-বোনদের আর্থিক সাহায্য সহযোগিতায় মাদরাসার জন্য প্রতিবারই বিপুল পরিমাণ টাকা কালেকশন হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তাঁকেও প্রতিবার অনেক বড় অঙ্কের টাকা হাদিয়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হযরত আবদুল হাই রাহ. প্রতিবার-ই চাঁদা এবং হাদিয়ার সবগুলো টাকা মাদরাসার ফান্ডে জমা দিয়েছেন। নিজের জন্য একটি টাকাও রাখলেন না। কেউ কেউ এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেন, ভাই! আমি ব্যক্তিগত কাজে লন্ডন যাইনি, মাদরাসার জিম্মাদার হিসাবে গিয়েছি, সুতরাং এ হাদিয়াগুলো আমার নয়—মাদরাসার। হযরতের এমন কথা সম্পূর্ণ হাদিসের সাথে মেলে। বুখারি শরিফ ২য় খণ্ড ৯৮২/পৃ. এ ব্যাপারে বিস্তারিত হাদিস বর্ণিত রয়েছে।
দীর্ঘদিন মুসনাদে থাকা অবস্থায় জায়গা-জমি, দোকান-পাঠ, ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই করেননি? দারুণ অভাব-অনটনের ভিতর দিয়ে কোনো মতে সংসার চালাতেন। পরিবারে প্রায়ই ঋণ লেগে থাকত? পারিবারিক উন্নতির দিকে ফিরে তাকানোর কেনো সময় ছিল না। অসুস্থ অবস্থায় ৩/৪ বৎসর বাড়িতে থাকাকালীন থাকার ঘরের জীর্ণশীর্ণ অবস্থা দেখে তাঁর প্রবাসী ছাত্ররা জোর জবরদস্তি করে একটি পাকা ঘর বানানোর ব্যবস্থা করেছেন মাত্র। কিন্তু ছেলেরা এখনও বিয়ানীবাজারে সামান্য ব্যবসা করে, মাদরাসায় শিক্ষকতা করে কোনো মতে পরিবার চালাচ্ছেন। এটাই ছিল তাঁর আখিরাতমুখী হওয়ার বাস্তব নমুনা। আর قناعت বা অল্পে তুষ্টির অসংখ্য ঘটনাবলি ও কথার মধ্য থেকে হযরতের নিজেরই বলা একটি কথা উল্লেখ করা যথেষ্ট মনে করছি। হযরত রাহ. বলেন, আমার যদিও অর্থ কড়ি, ধন-সম্পদ নেই, তবে মনের দিক দিয়ে আমি খুব শান্তিতে আছি এবং সুখ-শান্তির জীবন-যাপন করছি।
সাত. সবর ও শোকর
হযরত আবদুল হাই রাহ.-এর পুরো জীবন ছিল সবর ও শোকরের গুণে সাজানো। তাঁর পবিত্র জীবনের সবর ও শোকরের অসংখ্য ঘটনাবলি ছাত্র-শিক্ষক পরিবার-পরিজন তথা দেশবাসীর মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে। এগুলো এত স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা কঠিন।
আট. পরহেযগারি
হযরত রাহ.-এর গোটা জীবনটাই পরহেযগারির সর্বোত্তম নমুনা ছিল। সকল হারাম বর্জনই শুধু নয়; সন্দেহজনক সকল কথা-বার্তা ও কাজ থেকেও হযরতের অবস্থান ছিল অনেক দূরে। যেসকল বিষয়কে ছোট-খাট মনে করে আমরা অহরহ করে ফেলি, অথচ সূক্ষ্ম নজরে তাকালে শরিয়তের দৃষ্টিতে তা সঠিক নয়, এমন সব কাজ-কর্ম, আচার-আচরণ থেকেও হযরত রাহ.-এর অবস্থান ছিল অনেক দূরে। ছোট্ট একটি ঘটনা উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
একদা হযরতের জন্য মসজিদের হুজরাতে রাখা খানা মাদরাসায় নিয়ে আসা হল, কিন্তু ভুলে লবণ আনা হয়নি। খেতে বসে দেখা গেল লবণ নেই। জনৈক ছাত্র তাড়াতাড়ি মাদরাসার বোর্ডিং থেকে লবণ নিয়ে এল। হযরত জিজ্ঞাসা করলেন, এত তাড়াতাড়ি লবণ কোথা থেকে আনা হল? জবাব দেয়া হল- বোর্ডিং থেকে।
হযরত রাহ. তৎক্ষণাৎ কিছু পয়সা বোডিং-এ জমা দিলেন। এরপর উক্ত লবণ দ্বারা খানা খেলেন। পরহেযগারির কী অনন্য দৃষ্টান্ত!
নয়. তায়াক্কুল (আল্লাহর উপর ভরসা)
تسليم (আত্মসমর্পণ) رضا بالقضاء (আল্লাহর ফায়সালায় সদা সন্তুষ্টি) এ সকল গুণ যেন হযরতের স্বভাবজাত গুণ ছিল। এর বিপরীত যেন তাঁর বেলায় কখনও কল্পনাও করা যেত না। সবসময় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে চলতেন। সদা আল্লাহর উপর ভারসা রাখতেন। কঠিন বিপদ আপদে প্রায় সকলেই যেখানে ঘাবড়িয়ে যেতেন, এমন কঠিন সময়ও তিনি অটলও অবিচল থাকতেন। এটাই ছিল আকাবিরে দেওবন্দের বৈশিষ্ট্য। তাঁদেরই সঠিক উত্তরসূরি ছিলেন আমাদের হযরত আবদুল হাই রাহ.।
দশ. রাজনৈতিক অঙ্গনে
তিনি আকাবিরদের এ সুন্নাতটিকেও খুব শক্ত ও মজবতুভাবে ধরে রেখেছিরেন। আকাবিরে দেওবন্দের রেখে যাওয়া আমানত, হক ও হক্কানিয়য়াতের তরজমান, “জমিয়তে উলামায় ইসলাম” এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল নিবিড়ভাবে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনের সমর্থক ছিলেন। এর সহযোগিতা করতেন সার্বিকভাবে। মাঠকর্মী হিসাবে তাঁকে না দেখে আমরা তাঁকে মূল্যায়ন করব জমিয়তের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার অফিসার হিসাবে। হাজারো সেনাবাহিনী পাওয়া যায় কিন্তু সমরনায়ক পাওয়া দুর্লভ।
তিনি শুধু একজন উচ্চস্তরের বিদগ্ধ মুহাক্কিক আলিম, উর্দু-আরবির সাহিত্যিক, সফল ও সুদক্ষ প্রিন্সিপাল, দক্ষ কারিগর, মসজিদের ইমাম ও খতিব, বিশিষ্ট কারি, হাক্কানি পীর ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন দ্বীনের দুর্দিনে রাজপথের সিপাহসালার। অন্যায়ের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন তিনি সবসময়। তাঁর কোনো নিকটজনও তাতে মনঃক্ষুণœ হলে হক্ক ও হক্কানিয়ত থেকে তিনি কখনও বিচ্যুত হন নি।
সকলের সাথে তিনি খুব ভালোভাবে মিশতে পারতেন। কারো সাথে তাঁর কোনো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও তাঁর মধুর আচরণে মুগ্ধ হত। তাঁর ঐতিহাসিক জানাযা-ই সে কথার সাক্ষর বহন করে।
হযরত শায়খ রাহ. প্রায় বলতেন, দুনিয়াতে লোকের কোনো অভাব নেই, কিন্তু মানুষের বড়ই অভাব। লোক অনেক পাওয়া যায়; কিন্তু প্রকৃত মানুষ পাওয়া যায় না। সত্যি বর্তমান পৃথিবীতে বহু রকমের, বহু রঙের, বহু প্রকৃতির, বহু আকৃতির লোক আছে; কিন্তু প্রকৃত মানুষ খুঁজে বের করা খুবই কঠিন।
হযরত রাহ. বলতেন, মানুষের মধ্যে কে প্রকৃত মানুষ তা বুঝা যায় দু’টি জিনিসের দ্বারা।১. তার সাথে সফর করার দ্বারা ২. পরস্পর লেনদেন দ্বারা। মানুষ যে কত খারাপ ও নিকৃষ্ট হতে পারে তা উপর্যুক্ত দু’টি মূলনীতি দ্বারা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়।
মানুষের মধ্যে অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা ইত্যাদি রিপু লুকায়িত থাকে, যার কারণে মানুষে-মানুষে হানাহানি, মারামারি, সংঘাত-সংঘর্ষ, গিবত-শিকায়তসহ বিভিন্ন মানসিক সমস্যাবলি সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমি অধম দীর্ঘ এক যুগ পর্যন্ত তাঁর অত্যন্ত কাছে থাকার এবং খিদমত করার সুযোগ হয়েছে—কোনা দিন তাঁর মাঝে এসব রিপু ও রোগগুলো দেখিনি। মানুষের ভিতরে শুধু গুণ থাকলে হয় না; বরং কু-রিপুসমূহ—যা অন্তর থেকে দূর করাও একান্ত দরকার। এর সংখ্যাও অনেক। এর মধ্য থেকে কয়েকটি প্রধান ও মূল। যেমন: অহংকার, মিথ্যা, হিংসা, লোভ, দূরাশা, কৃপণতা, অবৈধ জিনিসের লিপ্সা, লোক দেখানো, পরনিন্দা, শত্র“তা, খোদ পছন্দি।
উল্লিখিত কু-রিপুসমূহ মানুষের শত্র“। যে কোনো পাপকাজের মূলে এর কোনো না কোনোটির প্ররোচনা নিশ্চয়ই থেকে থাকে। কু-রিপু থেকে আত্মাকে পবিত্র করা তাসাওউফের অন্যতম রোকন। কু-রিপুর সাথে হযরত শায়খের এত দূরত্ব ছিল যে, মনে হয় যেন আল্লাহ তায়ালা এ সব কু-রিপু থেকে পাক-পবিত্র করেই তাঁর অন্তরকে সৃষ্টি করেছেন। قلب سليم যাকে বলে তা যেন পুরো মাত্রায় হযরত রাহ.-এর মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
ছোট্ট একটি ঘর নিয়ে যিনি সামান্য টাকার মাসিক বেতনে যিনি তৃপ্ত, কার্পণ্যতা তাঁর কাছে আসবে কেমন করে, যিনি মাদরাসার বোর্ডিং এর লবণের মূল্য পরিশোধ না করে উক্ত লবণ দিয়ে খানা খান না, হারাম বা অবৈধ বস্তুর লিপ্সা তাঁকে কিভাবে স্পর্শ করতে পারে? সদা-সর্বদা যিনি নিজের দোষ-ত্র“টি পর্যালোচনার ব্যস্ত, সর্বদা যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বতে বিভোর, প্রতিটি মুহূর্তকে যিনি মূল্যবান গণীমত মনে করে সদ্ব্যবহার করতে সচেষ্ট, গিবত বা পরনিন্দার মতো অনর্থক ও ধ্বংসাত্মক চরিত্রের সাথে তাঁর কী সম্পর্ক থাকতে পারে?
মিথ্যাকে যিনি প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করতেন, তাঁর পুরো জীবনটাই ছিল মিথ্যা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। একবার জযবার হালতে হঠাৎ বলে ফেলেছিলেন, আল্লাহ তায়ালা এই মুখের দুয়া কেন কবুল করবেন না। এ মুখ তো ৪০ বছরেও একটি কথা মিথ্যা বলেনি। সুবহানাল্লাহ! কী আশ্চর্য্য ব্যক্তিত্ব হযরতের! হিংসার সাথে তাঁর ছিল না দূরতম সম্পর্কও। মানুষের কল্যাণ সাধন ছিল যার জীবনের পবিত্র সাধনা—হাসাদ বা হিংসার মতো আত্মিক ব্যাধি তাঁকে কিভাবে স্পর্শ করতে পারে?
নিজেকে মিটানোর পরিচ্ছেদে যে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে তাতেই বুঝা যায়, এই মাটির মানুষের সাথে অহংকারের কোনো সম্পর্কই ছিল না। ছিল না খোদ-পছন্দেরও কোনো সম্পর্ক। আর যাঁর জীবনের সকল কর্মকাণ্ড, আচার-আচরণ ইসখলাসে পরিপূর্ণ, রিয়া বা লৌকিকতার কোনো কালিমা মুহূর্তের জন্যও তাঁকে কলুষিত করতে পারেনি।
মোটকথা সকল কু-রিপু থেকে মুক্ত স্বচ্ছ আয়নার মতো পরিস্কার ছিল তাঁর অন্তর। একদিকে আল্লাহপাক সৃষ্টিগতভাবে তাঁকে এক পবিত্র অন্তর দান করেছিলেন। অপরদিকে পীরে কামিল, খলিফায়ে মাদানি হযরত শায়খ আবদুল মতিন ফুলবাড়ি রাহ.‘র নেক সোহবতে ও নিরবিচ্ছিন্ন আধ্যাত্মিক সাধনায় তাঁর অন্তরাত্মাকে করেছিল, সুরভিত ও আলোকিত। হযরতের কাছে বসলেই এক মানসিক প্রশান্তি ও আন্তরিক তৃপ্তি সকলকে মুগ্ধ করত।
হযরতের একটু খানি সোহবতেই পাষাণ হৃদয় গলে যেত। পাপিষ্ঠ আত্মা কেঁপে উঠত, মন নরম হয়ে যেত, অন্তর এক ভিন্ন জগতে চলে যেত, হৃদয় মাঝে আল্লাহপাকের মহব্বতের ঢেউ খেলে উঠত, নেক আমলের আকর্ষণ জন্মাত, পাপ ছেড়ে দেওয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হত। এমন প্রভাব সৃষ্টিকারী সাহচর্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কি?
সত্যিই আমরা হতভাগা, এমন একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষকে হারালাম, যিনি ছাত্র হিসাবে ছিলেন শিক্ষকদের অতি øেহের, শিক্ষক হিসেবে ছিলেন ছাত্রদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার, পুত্র হিসাবে ছিলেন মা-বাবার কলিজার টুকরা, স্বামী হিসাবে ছিলেন স্ত্রীর নয়নমণি, বাবা হিসাবে ছিলেন পুত্র-কন্যার এক নির্ভরযোগ্য অভিভাবক। ভাই হিসাবে ছিলেন বোনের পরম আপনজন, প্রতিবেশী হিসাবে ছিলেন প্রতিবেশীর অনন্য সহযোগী, আর্ত-মানবতার ছিলেন পরম দরদি বন্ধু। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের ছিলেন একান্ত আশ্রয়স্থল, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে লাখো কোটি ভক্ত অনুরক্তের ছিলেন হৃদয়ের স্পন্দন, সর্বোপরি যিনি ছিলেন বিশ্ব নবীর এক উজ্জ্বল নমুনা। বিশ্বনবীর কদম কদম তিনি অনুসরণ-অনুকরণ করেছেন। তাঁর প্রায় শতবর্ষী জীবনের একটি দিক বা বিভাগও এমন খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে তিনি বিশ্বনবী সা.-এর কথা, কাজ ও আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন নি।
জীবনের প্রতিটি স্তরকেই তিনি সাজিয়েছিলেন বিশ্বনবীর নকশা-নমুনায়। মহানবী সা.-এর অনুপম আদর্শে জীবন গড়ে কত বড়, কত দামি হওয়া যায়, হযরত আবদুল হাই রাহ. তা প্রমাণ করে দেখিয়ে গেছেন নিজ জীবনে।
উপসংহার
আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর হাতে গড়া তাঁর উত্তরসূরিরা রয়েছেন। তাঁর মহান দায়িত্ব পালনে আজ তাঁদের-ই এগিয়ে আসতে হবে। হযরত আবদুল হাই (ইমাম সাহেব হুজুর রাহ.)এর মহান স্বপ্নের বাস্তবায়নে তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরিদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসার জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছি।
তবেই তাঁর আত্মা পরিতৃপ্ত হবে জান্নাতের সুবাসে। সর্বশেষ যে কথাটি তাঁর উত্তরসূরিদের কাছে আমি রাখতে চাই, তা হচ্ছে বিশাল ব্যক্তিত্ব, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এ ক্ষণজন্মা এ মহাপুরুষ হযরত আবদুল হাই রাহ. বিয়ানী বাজার থানায় যেসব ছোট-বড় দ্বীনি প্রতিষ্ঠান আমানত হিসাবে রেখে গেছেন—তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ একান্ত প্রয়োজন। এ ব্যাপারে তাঁর উত্তরসূরিদের এবং দেশ-বিদেশে তাঁর অনুরাগী, ভক্ত অনুরক্তদের অবশ্যই বিশাল দায়িত্ব রয়েছে। সকলেই দায়িত্ব সচেতন হলে তাঁর স্মৃতি, তাঁর অবদান সংরক্ষিত থাকবে ইনশাআল্লাহ। দেশবাসী এলাকাবাসী, আজীবন উপকৃত হতে থাকবে এ সকল প্রতিষ্ঠান থেকে। আর এ মানব-দরদি, দ্বীন-দরদি, মহান ব্যক্তিত্ব আজীবন সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব উপভোগ করবেন, যতদিন তাঁর হাতে গড়া এ জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরসহ সকল ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন। এই কামনা।
লেখক
ফাযিলে জামিয়া
মুহতামিম ও শায়খুল হাদিস,
জামেয়া হাজি সাইজ উদ্দিন আনওয়ারুল উলুম কুতুবআইল
নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা