মুহাম্মদ এবাদুর রহমান: একটি জলাশয়। তৃণলতা বেয়ে আছে। নিবিড়তা ছেয়ে আছে। তার উপর নির্জনতা সবসময়। সদা শঙ্কা। বুক কাঁপে দুরু দুরু। পাশে একটি আঁকা-বাঁকা রাস্তা। নোংরা জলাশয়। কাছে জঙ্গল।  দূষণীয় জল। পানিতে নেই তরলতা। মানুষ দিন দুপুরেও যায় না। মনে ভয় জাগে। রাতের তো প্রশ্নই ওঠে না। দিনদুপুরেও কেউ চলতে সাহস পায় না। পশুও চরে না। পাখিরা আসে না। গান গায় না। এমন নিঃসঙ্গতা দূরিভূত হল। নীরবতা কেটে গেল। ছন্দপতন ঘটে গেল। এল এক ঝাক মৌমাছি। বাঁধল মৌচাক। শুরু হল গুঞ্জন। জ্বলে ওঠল আলাদীনের প্রদীপ। তা আবদুল হাই রাহ.-র প্রচেষ্টায়।

এই জলাশয় নেই আর। বদলে গেছে। পাল্টে গেছে তার দৃশ্য। একটি নববি বিতান। প্রতিষ্ঠিত হল দারূল কুরআন। সুসজ্জিত কুঞ্জে মৌমাছিরা আসে। মধু আহরণ করে। দূরের-কাছের। সবখানের। সতেজ প্রতিটি ফুলের প্রাণ। উদ্ভাসিত হেরাব নূরে। ফুলে ফুলে শোভিত। চতুর্দিক সুভাসিত। বিচিত্র প্রজাপতির মেলা। পাখ-পাখালির খেলা। কুরআনের দারস, হাদিসের পাঠদান। হামেশা হকের বয়ান। সব মিলে নীরব এক অভিযান। যা বলেছে কুরআন- ‘যাআল হাক্ব ওয়া যাযকাল বাতিল”। তাই তো নামকরণ যথার্থ—‘দারুল কুরআন’।

শায়খ আবদুল হাই রাহ. যান লন্ডন সফরে। ১৯৯৬ সনের পূর্বে, চাঁদা কালেকশনে। জামেয়া মাদানিয়া আঙ্গুরার। চাঁদা দেন মাথিউরার অনেকে। তারাও রাখেন আবদার। আশ্বাস দেন সার্বিক সহায়তার। একটি মাদরাসা স্থাপনের। নিজ এলাকায়। দেশে এসে দাবি রাখেন লোকজন।  আবদুল ওয়াহিদ,আবদুল বাসিত (সাধু), মৃত বাবুল মিয়া, মৃত এখলাসুর রহমান, নিজাম উদ্দিন, মাসুক আহমদ, মাওলানা রশিদ আহমদ। আরো বহুজন দ্বীন দরদি গুণীজন। তাঁরও স্বপ্ন হৃদয় গহীনে। তাদের অনুরোধে মগ্ন হন তাতে। আয়োজন হল ক’টি মজমার। হাসিমুখে মেনে নিল। সাদরে গ্রহণ করল তাদের প্রিয়জন। শ্রদ্ধেয় সবর্জন। না মেনে কি পারা যায়? ফেলে রাখা যায় কি তাঁর কথা?

কোথায় হবে এ কানন? কোন যমিন করবে প্রস্ববণ? নেই ভূমি। পানি আর পানি। এখানে কি নির্মাণ করা যায় মাদরাসা? ভাবনার নেই অন্ত। হ্যাঁ, যে স্থান নির্জন। সেখানে হবে পাখিদের গুঞ্জন। সুন্নতের রবি ওঠবে। দ্বীনের পতাকা ওড়বেই। আকাবিরদের মতো আগামীতে দ্বীনের মারকায হবে। বাহাদুরি বাড়ির ইজমালি জায়গা মনস্থ করলেন। ৩২ শতক। পরে পরিধি আরো বিস্তার লাভ করেল। মাটি ভরাট করা হল। বাহ! এখন দেখতে যেন গোবরে পদ্মফুল। তিন তলা ফাউন্ডেশন। তৈরি হয় তিনটি কামরা। অফিসসহ। কাইদে উলামা আবদুল করিম শায়খে কৌড়িয়া আসেন। ভিত্তি স্থাপন করেন। এখন মনোরম বাগান দেখাচ্ছে। তবু পেরেশন। দেয়াল কাঁচা। প্রতিকূলতার ছোঁয়ায় ভেঙ্গে যেতে পারে। এ ভয়ে পাহারা দিতে হয় রাতে। আবদুল বাসিত সাধু  সাহেব ও হাজি আবদুল ওয়াহিদ ছিলেন তাতে। ধীরে ধীরে শক্ত হয়েছে। শিকড় পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। যেন সত্যের একটি পিরামিড।

তিনি নিজেই পরিচালক। এত দায়িত্বের মঞ্জুরি। আদায় করা মুশকিল। প্রয়োজন নির্বাহী পরিচালকের। মনোনীত করেন মাওলানা আবুল কাসিম সাহেবকে এ পদে। তাঁর হাতে গড়া ব্যক্তিত্ব। একেবারে তাঁরই মেজায। পরিচালনার ধরনটাও অভিন্ন। তাই মাদরাসা চলছে উন্নতির শিখরপানে। ঈর্ষান্বিত তাঁর কামিয়াবি।

সফলতার মূল হলেন শিক্ষাসচিব। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের। সকল বিদ্যাপীঠের। মাওলানা মাহমুদ হাসান নিয়োগ হন। শিক্ষা সচিব পদে। তাঁর দক্ষ পরিচালনায় নিয়মিত মেহনতে ভালো ফলাফল অর্জনে সক্ষম হয়েছে ছাত্ররা। সহকারী মাওলানা রাশিদ আমমদ সাহেব। মোট তিন জন। লেখাপড়ার মান আছে, অসাধারণ সাফল্য আছে, মাদরাসার বৈশিষ্ট্য রূপে আছে। এখন আর ভয় নেই। লোকজন অহর্নিশ চলাচল করতে পারে। আলোময় চতুর্দিক।

মাদরাসা মসজিদ নির্মিত হল। তাঁর জীবদ্দশায় ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপিত হল। হাজিপুরি, গাজিনগরি, মহিষপুরি প্রমুখের পদভারে ধন্য হল। তিনি হাজির ছিলেন। “আল ফুরকান” দেয়ালিকার সম্মানিত উপদেষ্টা তিনিই। আল্-ইখওয়ান ছাত্রসংসদ থেকে প্রকাশিত। বার্ষিক জলসায় শোভা পেত। সভাপতিত্বে তার দুয়াও ঠাই পেত। দূর দূর থেকে আনতেন চাঁদা মাদরাসার জন্য। চাঁদাও দিতে এলাকাবাসীর একেবারে অনাগ্রহ ছিল না।

আজ মাতোয়ারা সারা এলাকা। পুষ্পের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ায়। মধু মক্ষিকার গুঞ্জনে মুখরিত হওয়ায়। কী সুন্দর তাঁর নববি বাগান। আপন ঐতিহ্যের জানান দিচ্ছে।

‘বাতির নিচে অন্ধকার’ প্রবাদ রয়েছে। যথার্থ নয় তা মুহতামিম সাহেবের জীবনে। শুধু আলোকিত করেন তিনি। নিকষ আঁধারে আচ্ছন্ন সমাজকে গড়ে তুলতে পেরেছেন কুরআন-সুন্নাহর আলোকে। প্রায়টিই। অনেক ক্ষেত্রে তা না হলে ব্যতিক্রমী সমাজে এমন বিদ্যাপীঠ! স্বপ্নেও ভাবার নয়। চিন্তায় আসার নয়। মানবে না বিবেক। সমাজকে এরই ছাঁচে পরিবর্তন। দুরূহ ব্যাপার। কারামাত ছাড়া কিছু নয়। প্রভুর দান। আঁখি জলের নজরানা। কবুল করো প্রভু রাব্বানা।

লেখক: শিক্ষার্থী (২০১১), মাথিউরা দারুল কুরআন মাদরাসা, বিয়ানীবাজার, সিলেট