সাদ উদ্দিন: মানুষের সহজাত প্রবণতা হল ক্রমাগত প্রয়োজন পূরণ করা। এরপর আবার প্রয়োজন তৈরি করা। আবার তা পূরণ করা। এভাবেই মানুষ বস্তুবিশ্বের পেছনে উন্মাদের মতো ছুটতে থাকে। জীবনের এসব প্রয়োজন স্বীকার্য বটে; কিন্তু জীবনের লক্ষ্য নয়। প্রয়োজন এবং লক্ষ্যের এ পার্থক্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে, পাথেয়কে গন্তব্য বানিয়ে মানুষ তাদের মানবজীবনকে পথের ধুলোয় হারিয়ে ফেলে স্রেফ অমানুষিক জৈবসত্তায় পর্যবসিত হচ্ছে। অথচ ইসলামি জীবনবোধ হচ্ছে মানুষের পার্থিব জীবন পরকালের শস্যক্ষেত্র। সীমিত এ জীবনে ফলিয়ে যাওয়া ফলই সে ভোগ করবে অনন্ত আখিরাতে। এখানকার হিসেবটাই মূখ্য নয়; বরং পরজীবনের পরিণতির বিবেচনায় তার ইহজাগতিক যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। একজন পথিক যেমন তার বিশ্রামস্থলকে স্থায়ী ঠিকানা মনে করে না, ভোগের নেশায় এখানে সে মেতে ওঠে না, তেমনি দুনিয়াও মানুষের সাময়িক অবস্থানস্থল, পান্থশালা। ক্ষণিকের আবাসে আড়ম্বর ও লৌকিকতা প্রদর্শন কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই তো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তুমি দুনিয়াতে এমন হও, যেন তুমি একজন আগন্তুক, অথবা পথিক এবং নিজেকে কবরবাসীদের সঙ্গে গণনা করো।” (বুখারি) অন্য এক হাদিসে আছ, “প্রকৃত বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি; যে নিজেকে চেনে এবং পরকালীন পাথেয় সঞ্চয় করে।” (তিরমিযি)
ইসলাম মানুষকে সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনে উৎসাহিত করে। তাগিদ দেয়, যেন লৌকিকতা জীবনের স্বাদ না হয়। অতিরিক্ত জাঁকজমক ও আড়ম্বর ইসলাম নীতিগতভাবে যেমন সমর্থন করে না, তেমনি প্রায়োগিক ক্ষেত্রেও। আল্লাহর প্রিয় হাবিব, সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর জীবনধারা ছিল অতি সাধারণ। প্রাচুর্য আর ঐশ্বর্যের হাতছানি উপেক্ষা করেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন সহজ ও অনাড়ম্বর জীবন। সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের এমন কঠিন অনুশীলনের দ্বিতীয় কোনো দৃষ্টান্ত নেই। নবীর আদর্শের মূর্তপ্রতীক সাহাবাগণের জীবনধারাও ছিল নববি আদলে সাবলীল ও সাদাসিধে।
ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর রাযি. এর পতœী একবার কিছু মিষ্টিজাতীয় খাবার তৈরি করে পরিবারের সকলকে খাওয়ানোর ইচ্ছের কথা স্বামীকে জানালেন। খলিফা অসম্মতি জানিয়ে বললেন, মিষ্টির জন্যে যে অর্থের দরকার তা আমার কাছে নেই। খলিফাপতœী তবু প্রতিদিনের খাবার থেকে অল্প অল্প করে মিষ্টির জন্য সঞ্চয় করে একদিন ঠিকই মিষ্টান্ন তৈরির উপকরণ জোগাড় করে আনন্দের সঙ্গে খলিফাকে অবহিত করলেন। শুনে খলিফা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, এই সঞ্চয়ের দ্বারা প্রমাণ হল যে, এ পরিমাণ খাবার বায়তুল মাল থেকে না নিলেও আমার সংসার চলত। তার পর ওগুলো বায়তুল মালে ফেরত দিয়ে আগামীতে এ পরিমাণ মাল কম দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মচারিদের নির্দেশ দিলেন।
দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর অর্ধজাহানের বাদশা হয়েও বায়তুল মাল থেকে যে ভাতা নিতেন, তাতে সংসার চলত না। শীর্ষস্থানীয় সাহাবাগণ তাঁর ভাতা বৃদ্ধির পরামর্শ করলেন। কিন্তু উমরের কাছে এ প্রস্তাবের কথা কে বলবে, কারো সাহস হয় না। অবশেষে হাফসা রাযি.’র মাধ্যমে তাঁর দরবারে প্রস্তাবটি পেশ করা হল। তিনি তা প্রত্যাখান করে নিজের মেয়ে হাফসাকে রাসূলের সাদাসিধে জীবনযাপনের কয়েকটি চিত্র স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, আল্লাহর প্রিয় হাবীব এবং আবু বকর যেভাবে সাদাসিধে জীবনযাপন করে গেছেন, আমি সে আদর্শের অনুসরণ করেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে চাই।
কিংবদন্তি মুসলিম শাসক উমর বিন আবদুল আযিয খলিফা নির্বাচিত হলে রাজকীয় ঘোড়াগুলো থেকে সেরা ঘোড়াটি তাঁর সামনে পেশ করা হল। খলিফা হেসে বললেন, এতো তেজি ঘোড়ার প্রয়োজন আমার নেই; পুরাতন খচ্চরটিই আমার জন্যে যথেষ্ট।
কালের স্রোতধারায় ভোগ-বিলাসের সম্ভারে ডুবে, আবিল জীবনবোধে অভ্যস্ত আমাদের চোখে সেইসব সরল সুন্দর জীবনের নিভৃত দ্যুতি ধরা পড়ে না। কিন্তু সেই গল্পগুলো শুধুই অতীতের গল্প নয়, আজকের জটিল সময়েও কিছু আধ্যাত্মিক জ্ঞানসাধকরা একান্তে পরমাত্মার সান্নিধ্যে মগ্ন হয়ে আশ্চর্য সরল জীবনযাপন করে চলেছেন। আমরা তাঁদের দিকে ফিরে তাকাবার অবসরটুকুও পাই না। এঁদের সময়, মেধা ও শ্রম সবই অন্যদের জন্য নিবেদিত। এমনই একজন সাধকপুরুষ আমার পরম শ্রদ্ধেয় উস্তাদ শায়খ আবদুুল হাই রাহ.। একজন সহজ মানুষ। একটি আলোকিত জীবন। খানা-পিনা, লেবাস-পোশাক, চলাফেরা, পারিবারিক, সামাজিক তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ছিলেন ঋদ্ধ অথচ অনাড়ম্বর। অভাব বা অসচেতনতার কারণে নয়। যেমনটি অনেকের মধ্যে দেখা যায়; বরং অত্যন্ত যুগসচেতন হয়েই তিনি সাধাসিদে জীবন বেছে নিয়েছিলেন। অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা যেভাবে তাঁর কাছে পছন্দনীয় ছিল, তেমনি তিনি প্রায় সময় তাঁর প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরকে আন্তরিকতার স্বরে অনুনয় করে বলতেন, ‘আপনারা খরচ বেশি করে ফেলেন। জীবনকে ইচ্ছে করলেই তো আরো সহজ করা যায়।’
তিনি চাইলে অঢেল অর্থ সঞ্চয় করতে পারতেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাদরাসার প্রয়োজনে তিনবার লন্ডন সফর করেছেন। কিন্তু সফরের পরের অবস্থা আগের অবস্থার চে’ কখনোই ভালো মনে হয় নি। ছাত্র, ভক্তরা হাদিয়া হিসেবে তাঁকে যা দিয়েছিলেন, তিনি তাও রশিদ কেটে মাদরাসায় দিয়ে দিতেন। এক ভক্ত পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে ব্যক্তিগত কাজে ব্যয় করার জন্যে বারবার বলে দেওয়ার পরও ঢাকায় নেমে সে টাকা দিয়ে মাদরাসার সকল শিক্ষকের জন্য জামাকাপড় কিনে নিয়ে আসেন। নিজে অতি সাধারণ পোশাক পরতেন। এমনকি তালিযুক্ত কাপড় পরা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
শেষ সফরকালে তিনি বয়োবৃদ্ধ, শারীরিকভাবে দুর্বল, শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। এমতাবস্থায় খাদিম হিসেবে একজনকে সহজেই সঙ্গে নেওয়া যায়। কিন্তু তিনি এতে রাযি হননি।
তাঁর হাতে গড়ে ওঠেছে জামিয়ার দৃষ্টিনন্দন বড় কয়েকটি ভবন। চেষ্টা করেছেন তিনি উস্তায-ছাত্রদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর। কিন্তু নিজের জন্য বাড়িতে ভালো একটি ঘরও নির্মাণ করেন নি। কোনোমতে মাথা গুঁজা যায় এমন একটি সাদামাঠা ঘরে পুরো জীবনটাই কাটিয়ে গেছেন। তাঁর ভক্ত ও প্রবাসী ছাত্ররা একটি ঘর বানিয়ে দিতে একাধিকবার অনুমতি চেয়েছেন। প্রতিবারই একই উত্তর ‘আমার ঘরের চে’ মাদরাসার প্রয়োজন বেশি। তাই মাদরাসায় দিয়ে দাও।’ এমনকি পীড়াপীড়ি করলে অনেক সময় রেগে যেতেন। অবশেষে তাঁর জীবনের অন্তিম সময়ে নাযিম সাহেবের সুপারিশে তারা অনুমতি পান। কিন্তু ঘরের টাকা হুযুরের হাতে দেওয়া হলে তা যে মাদরাসার কাজে খরচ করবেন না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে। তাই বালিঙ্গা নিবাসী মাওলানা ফয়যুর রহমানকে ঘর বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বস্তুত এরূপ সাদাসিধে, আড়ম্বরহীন জীবনধারা স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া ঐ ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব, যার মধ্যে থাকে অল্পেতুিষ্ট, থাকে সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভরশীলতা। যার অন্তরাত্মা আল্লাহর প্রেমে এমন বিভোর যে, পৃথিবীতে কারো মায়া-মমতাই এর ওপর প্রবল হতে পারে না। যার কাছে পার্থিব ক্ষণস্থায়ী সুখ-শান্তি, যশ-খ্যাতি, ধন-সম্পদ ইত্যাদির এমন কোনো গুরুত্ব থাকে না, যা অর্জন করার জন্য সদা ব্যতিব্যস্ত থাকতে হবে। আর না এখানকার দুঃখ-কষ্ট, শ্রম-সাধনা কোনো লক্ষ্য করার বিষয়, যা প্রতিরোধ করতে গিয়ে অস্থির হয়ে উঠতে হবে। যার চরম ও পরম লক্ষ্য থাকে চিরস্থায়ী আখেরাত। যার দেহমন, ভেতর-বাহির সবই থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্বেষায়।
তাঁর আমানতদারীর ভেতরও পরিলক্ষিত হতো সরলতা। আজকের দিনে কেউ কি টাকা রাখার জন্য কাপড়ের থলে ব্যবহার করে? তিনি করতেন। মসজিদ, মাদরাসা ও তাঁর ব্যক্তিগত টাকা রাখার জন্য পৃথক পৃথক থলে রাখতেন। এমনকি মাদরাসার থলেতে প্রতিটি ফাণ্ডের জন্য আলাদা ভাগ থাকত। পারতপক্ষে এক ফাণ্ডের টাকা আরেক ফাণ্ডে নিতেন না।
তিনি যেমন ছিলেন সহজ-সরল, তেমনি বিনয়ী। তাঁর বিনয়ের অবস্থা ছিল এমন, আমার চার বছর পড়ালেখার জীবনে সবসময়ই এমনকি ছাত্রকেও ‘আপনি’ ‘আপনারা’ বলে সম্বোধন করতে দেখেছি। সাধারণ কোনো শিক্ষকের সঙ্গে প্রয়োজন হলে, তাঁকে ডেকে না এনে তিনি নিজেই সে শিক্ষকের কক্ষে চলে যেতেন। যে জামিয়া তাঁর হাতেই তিলে তিলে আজকের এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তার উন্নতির কোনো সম্বন্ধ নিজের দিকে না করে বলতেন, ‘এসব আমার নাযিম সাহেবের দূরদর্শিতা ও শিক্ষকবৃন্দের শ্রমের ফল।’ তখনকার শায়খুল হাদিস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী কোনো মাহফিলে উপস্থিত থাকলে মুহতামিম সাহেব হুজুর কোনো দুয়া পরিচালনা করেছেন বলে মনে পড়ে না। বারবার অনুরোধের পরও একই জবাব—‘আমি নালায়েক, আমি দুয়ার মুহতাজ।’ এভাবেই কেটে গেছে তার অনাড়ম্বর জীবন। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের অফুরন্ত নিয়ামত দান করুন! এই শান্ত মানুষের সহজ আলোকিত জীবন কি আমাদের জন্য আদর্শ হতে পারে না? নিশ্চয়পারে। আল্লাহ আমাদেরকে সেই পথে চলার তাওফিক দান করুন।
লেখক: শিক্ষক, শাহবাগ জামিয়া মাদানিয়া কাসিমুল উলুম, জকিগঞ্জ, সিলেট।