নুরুল ইসলাম আহমদাবাদি: উলামায়ে রব্বানি ও আহলুল্লাহদের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাদের কেউ কেউ সমসাময়িক যুগে মশহুর বা খ্যাতিমান। সর্বস্তরের মানুষের নিকট তাদের পরিচিতি, গ্রহণযোগ্যতা ও ভক্তি বিরাজমান। তাঁরা মশহুর বা পরিচিত হওয়ার জন্য আদৌ ইচ্ছুক না থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়াল মানুষের মধ্যে তাদের পরিচিতি, ভক্তি, শ্রদ্ধা, মহব্বত ও গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করে দেন। এতে অগণিত মানুষ তাদের ইলম এবং মারিফত দ্বারা উপকৃত হয়। হেদায়তের রাস্তা পায়। সর্বোপরী উসূল ইলাল্লাহ বা আল্লাহু পর্যন্ত পৌঁছা নসিব হয়। প্রত্যেক ব্যক্তি তার স্বভাবজাত যোগ্যতা অনুসারে তাঁদের কাছ থেকে উপকৃত হয়। এসব আল্লাহ ওয়ালারা অবস্থা এবং ব্যক্তিভেদে একেকটা উজ্জ্বল বাল্ব, পেট্রোমাকস এবং আলোকবর্তিকার মতো। তাদেরকে সময় সময় নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু তাদের ইসলাম, রুহানিয়্যাত, আল্লাহর উপর ভরসার সামনে এসব সমস্যা বালুর বাধের মতো ভেসে যায়। আর্থিক দৈন্যতা, সমাজ ও পরিবেশগত বাধা, স্বৈর সরকারের ক্ষমতার দম্ভ, তাদের রক্তরাঙ্গা চোখের চাহনি কোনোকিছুই তাদের যাত্রাপথে বাঁধা দিতে পারেনি। ইতিহাসের পাতায় এ জাতীয় বুজুর্গানে দ্বীনের সংখ্যা অজস্ত্র, অগণিত; পরিসংখ্যান বহির্ভূত। আমি এখানে একজন আল্লাহ ওয়ালার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছি। ইনি হচ্ছেন সুলতানুল আওলিয়া হযরত নিজাম উদ্দিন রাহ.। তিনি বাবা ফরিদে গঞ্জেশকর রাহ. এর খলিফা। তিনি কুতবুল আলম কুতবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি রাহ. এর খলিফা। তিনি ইমামুল হিন্দ হযরত মুঈনুদ্দিন হাসান সঞ্জরি চিশতি রাহ. এর খলিফা। হযরত সুলতানুল আউলিয়া নিজাম উদ্দিন রাহ.কুরআন,হাদিস,আরবিসাহিত্য এবং ফার্সিতে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। দিল্লিতে তাঁর দরবারে মানুষের সমাগম ইতিহাসের এক কিংবদন্তি। তাঁর খলিফা হযরত আমির খসরু রাহ. ভারতে মুসলিম শাসনের সবচেয়ে বড় স্বৈরাচার সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির দরবারের একজন সভাসদ ছিলেন। হযরত আমির খসরুকে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিল যে, সুলতানুল আউলিয়ার দরবারে মানুষের সমাগম কি রকম? উত্তরে তিনি জবাব দেন, আকাশের নক্ষত্রের বরাবর। খানকা শরীফের লঙ্গরখানায় মন মন লবন, টন টন চাউল এবং আম দস্তারখানা খোলা ছিল। এই ছিল রুহানিয়্যাতের বাদশা সুলতানুল আউলিয়ার দরবারের সংক্ষিপ্ত হাল। অন্যদিকে ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় বাদশাহ স্বৈরশাসক সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির জৌলুসপূর্ণ দরবার। ঐতিহাসিকগণ তাকে দ্বিতীয় সিকন্দর যুলকারনাইন বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই অশিক্ষিত স্বৈরশাসকও ইতিহাসের এক চমক। আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন ভারতে মুসলিম শাসনে সবচেয়ে বড় ভূখণ্ডের মালিক। তার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (price control system) ছিল এরকম যে, সারা দেশে একই দামে দ্রব্যাদি বিক্রি হবে, পাহাড়, জঙ্গল, হাওর সর্বত্র মানুষের জান ও মালের নিরাপত্তা থাকবে। এরকম আরো বহু জিনিস ইতিহাসবিদদের নিকট আজকে কল্পনার বস্তু। একবার তিনি সিকন্দর যুলকারনাইনের মতো দ্বিগি¦জয়ে বের হওয়ার চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। তার মুকাবেলায় নিজ রাজধানী দিল্লি শহরে তার কোনো সমকক্ষ থাকবে এটা ছিল তার চিন্তার বাইরে। তিনি নির্দেশ দিয়েও সুলতানুল আউলিয়াকে তার দরবারে হাজির করতে পারেন নি। অন্যদিকে পাল্টা প্রতিক্রিয়াগ্রস্ত হয়ে আতঙ্কে সুলতানুল আউলিয়ার মুলাকাত প্রার্থী হয়েও অনুমতি পাননি। এই ছিল দুনিয়ার বাদশাহ এবং রুহানিয়্যাতের বাদশার মুখোমুখি অবস্থা।
দ্বিত্বীয়ত আহলুল্লাদের মধ্যে আরেক দল যারা সমসাময়িক যুগে মোটেই পরিচিত নন। মানুষ তাদের পরিচয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এদের সর্ম্পকে কিছু জানতে গেলে জানা যায় না। লিখতে গেলে কিছু পাওয়া যায় না। কিন্তু তাদের রুহানিয়্যাত এবং নুরে মারিফতের বিস্ফোরণ এতই তেজস্বী যে, টর্চ লাইটের মতো সামনের জায়গাটা আলোকিত করার পরিবর্তে অনেক দূর-দূরান্ত পর্যন্ত আলোকিত করে। এ ব্যাপারে হযরত সুলতানুল আউলিয়ার পীর ভাই বাবা ফরিদে গঞ্জেশকর রাহ. এর খলিফা মাখদুমে জাহান আলা উদ্দিন আলী আহমদ সাবেরি রাহ. এঁর নাম উল্লেখ করা যায়। সমসাময়িক যুগে তাঁকে কেউ চিনত না জানত না। তাঁর দরবারে মানুষের কোনো সমাগম ছিল না। একমাত্র মুরিদ একমাত্র খলিফা তার জীবনসঙ্গী। ১২ বৎসর গুল গাছের ডালে ধরে ওয়াজদে (আত্মহারা) এর হালতে ছিলেন। আল্লাহপ্রেমের দরিয়ায় অকল্পনীয় অবগাহনের কারণে তিনি আত্মানুভূতিও হারিয়ে ফেলেছিলেন। মাখলুকাতের দিকে চোখ তুলে তাকাবার তাঁর কোনো অবস্থা ছিল না। অথচ লক্ষ লক্ষ লোক তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করেছিল। ভারতের মুসলিম ঐতিহাসিক পণ্ডিত আবুল হাসান আলী নদবি রাহ. এর ভাষায়—যে দুইজন মানুষ মারিফতের গভীর তলদেশ থেকে অমূল্য রত্নভাণ্ডার আহরণ করেছিলেন, এর একজন মাখদুমে জাহান আলা উদ্দিন আলী আহমদ সাবেরি আর অপরজন মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইলিয়াস। পাক-ভারত উপমহাদেশের চিশতিয়া তরিকার দু’টি ধারা বহমান। একটি চিশতিয়া নেজামিয়া। অপরটি চিশতিয়া সাবেরিয়া। আজকের পাক-ভারত উপমহাদেশের উলামায়ে কেরাম এবং মুসলিম জনতা যে তরিকা দ্বারা তৃপ্ত সেটা হচ্ছে তরিকায়ে চিশতিয়া সাবেরিয়া। হযরত হাজি ইমদাদ উল্লাহ মুহাজিরে মক্কি, ইমামে রব্বানি হযরত রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি, কাসিমুল উলুম ওয়াল খয়রাত হযরত কাসিম নানুতবি হযরত খলিল আহমদ সাহারানপুরি, হাকিমুল উমত হযরত আশরাফ আলী থানবি, আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশমিরি, শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানি রাহ. প্রমুখ লক্ষ লক্ষ উলামায়ে কেরাম এবং তাদের অনুসারী কোটি কোটি মুসলিম জনতার ঈমান, আমল, আখলাক ও রুহানিয়্যাত এ তরিকারই ফসল।
অপর ব্যক্তি হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইলিয়াস রাহ. সমসাময়িক যুগে মুফতি, মুহাদ্দিস, ওয়াইয, খতিব, মুনাযির, লেখক, বিপ্লবী, এসব কোনো নামেই পরিচিত ছিলেন না। অসুস্থ, দুর্বল এ মানুষটাকে পরিবারের লোকজন একটি বোঝা বলে মনে করত। তাঁর থেকে কোনো কাজ হওয়া তো দূরের কথা, তাঁর জীবন নিয়ে সবাই ছিল চিন্তিত। দিল্লি নেজাম উদ্দিনের ক্ষুদ্র বাংলাওয়ালি মসজিদের ইমামতি ছাড়া আর কোনো কাজের যোগ্য মনে করার উপায় ছিল না। কিন্তু তাঁর ভিতরে বহমান মারিফতের দরিয়া ও রুহানি শক্তির সাথে সাথে উম্মতের অকল্পনীয় দরদ এবং ফিকির জন্ম দিল বিশ্বজনীন দাওয়াতি কাফেলা। তাবলিগি জামাতের বিশ্বের উন্নত অনুন্নত দেশকে ছড়িয়ে সাহারার মরু অঞ্চল সাইবেরিয়ার তুষার অঞ্চল পর্যন্ত যাদের পদচারণা, ঈমান ও আমলের দাওয়াত এবং চৌদ্দশত বৎসরের পূর্বের নববি যিন্দেগির নূরানি ঝলকে উদ্ভাসিত। চৌদ্দশত বৎসরের ইতিহাসে হানাফি, মালেকি, শাফেয়ি, হাম্বলি, আহলে হাদিস একই প্লাটফরমে, একই আওয়াজ নিয়ে জমা হওয়ার নযির নেই। কিন্তু মাওলানা শাহ ইলিয়াস রাহ. এর তাবলিগি জামাতের মেহনতের বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা সবাইকে একই আওয়াজ নিয়ে একই প্লাটফরমে জমা হওয়ার তাওফিক দান করেছেন। ইউরোপ আমেরিকায় হাজারো হাজারো মসজিদ মাদরাসার প্রতিষ্ঠা সুন্নতে নববির যিন্দেগির নমুনা। এই জামাতেরই মেহনতের ফসল। আজকের মুসলমান অমুসলমান চিন্তাবিদেরা গবেষণার গহীন সমুদ্রে অবগাহন করে বুঝতে চেষ্টা করেন এই মানুষটা কী ছিল? যিনি সাদামাটা ছয়টি কথা দিয়ে উম্মতকে একই আওয়াজ নিয়ে একত্রে জমা করে দিয়েছেন। চিন্তাবিদের চিন্তা, গবেষকের গবেষণা যতই তীক্ষè এবং প্রখর হউক, এখানে তাদের ঠাই পাওয়ার কথা নয়। এটা রুহানিয়্যাত এবং আধ্যাত্মিক আলোকচ্ছটার বিচ্ছুরণ। যা বলব তা করব, বলা অনুসারে জীবন গঠন করব, লম্বা লম্বা বুলি নয়; বরং উপদেশের সঙ্গে উত্তম আদর্শই এ মেহনতের বৈশিষ্ট্য। উপদেশের সঙ্গে চাই উত্তম আদর্শ। উপদেশদাতা নিজে উত্তম আদর্শবান হলে অধিক উপদেশের প্রয়োজন হয় না। সূর্য বিশ্বচরাচরকে আলোকিত করে একথা বললে ভুল হবে; বরং সূর্য নিজের দ্বীপ্তিময় কিরণ নিয়ে আকাশে উদিত হয়। বিশ্বচরাচর এমনিতেই আলোকিত হয়ে যায়। এ বৈশিষ্ট্যকেই সামনে নিয়ে এই জামাতের মেহনতের দ্বারাই বিশ্বে আদর্শের বিজয় কায়েম করেছে। মাটির বিজয় এর পেছনেই আসছে। আসবে ইনশাআল্লাহ।
আমরা এখানে যে মানুষের জীবানালেখ্য পর্যালোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছি, তিনি আরিফ বিল্লাহ; কুতবে রব্বানি; বিয়ানীবাজারের উজ্জ্বল নক্ষত্র; পূর্ব-সিলেটের বৃহত্তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদাপুরের দীর্ঘদিনের মুহতামিম শায়খ আবদুল হাই রাহ.। তিনি এই দ্বিতীয় ধারারই এক মানুষ। তিনি না ছিলেন কোনো ওয়াইয বা বক্তা; না মুনাযির; না কোনো বিপ্লবী নেতা। তাই তার জীবনচরিত থেকে আলোকবর্তিকা হাসিল করতে হলে আলোচনার গহীন সমুদ্রে অবগাহন করতে হবে।
প্রচারবিমুখতা
মানব চরিত্রের যেসব দুর্লভ গুণাবলি তাঁর চরিত্রকে অলংকৃত করেছে এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রচারবিমুখতা। প্রচারেই প্রসার, প্রসারেই সাফল্য, এসব বর্তমানে অতি পরিচিত বুলি। নামি-দামি হওয়া বর্তমান জীবনধারার পরম লক্ষ্যমূল। দামি হতে হলে নামি হতে হয়, নামি হতে হলে ডিগবাজি দিতে হয়। নামের আগে পিছে খেতাব লাগাতে হয়, অন্যে ভুল করে ফেলবে এ চিন্তায় নিজেই বলে দেন বা লিখে দেন। পোস্টারে নাম এসেছে কিনা, থাকলে কোথায় উপরে না নিচে। মাইকিং যথাযথভাবে উপযুক্ত শব্দ দিয়ে হচ্ছে কি না। বক্তার সামনে তার কিছু প্রশংসাগীতি গাইতে হবে, হোক না সেটা হাদিসে রাসুলে নিষেধ। ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দটা আছে কী না, কুরআন শরিফের তরজমা না জানলেও মুফাসিসরে কুরআন বলতে হবে। জিন্দাবাদের শ্লোগান না দিলে মেহমানের অবমাননা করা হবে—এসব আমাদের আজকের দিনের চাহিদা। ‘অমুকের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’ অবশ্যই বলতে হবে। লাল গালিচা না থাকলে কি হবে, ‘লাল গোলাপ শুভেচ্ছা’ অন্তত মাইকে বলা চাই। পেটে বোমা মারলে ইলম বের হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও ‘আল্লামা’ বলতে হবে।
কিন্তু মাইকে নাম বললে যিনি নারাজ হন, খেতাব সংযোজন করলে যিনি বিরক্তিবোধ করেন, প্রশংসাগীতি গাইলে যিনি অসন্তুষ্ট হন, তার সম্পর্কে কী বলা যাবে। তাঁর সম্পর্কে বলা যাবে إنما نطعمكم لوجه الله لا نريد منكم جزاء ولا شكورا অর্থাৎ “আমি আমার কাজের পরিবর্তে তোমাদের থেকে কোনো বদলা বা প্রশংসাগীতি চাই না।” এটা হচ্ছে এখলাস এবং লিল্লাহিয়্যাতের এক উচ্ছতর মাকাম। প্রচারবিমুখতার এহেন অবস্থা তার কোনো লোকরঞ্জন ছিল না; বরং স্বভাবজাত। এজন্য কেউ এসব কাজ করতে যেত না। ধমকের ভয়ে নয়; বরং তার অন্তর নারাজ হবে, হয়তো বদদুয়ার ভাগিদার হয়ে বরবাদ হওয়ার ভয়ে। এ জিনিসটি আমাদের আজকের উলামায়ে কেরামের সমাজে এক প্রকট ব্যাধির রূপ ধারণ করেছে। কুত্বে বাঙ্গাল হযরত শায়খে কৌড়িয়া রাহ. প্রায়ই দু’টি কথা তিনি সব জায়গাই বলতেন-
এক. ভাইসব আপনারা গুমনাম জীবনযাপন করার চেষ্টা করবেন।
দুই. এবং নিজের আমল ও আখলাকের দ্বারা আসলাফকে বদনামি করবেন না।
আহ! আমাদের জীবনধারা এই বুযুর্গের দু’টি কথার সম্পূর্ণ বিপরীত। নাম চাই, দাম চাই, চাই পরিচিতি ও খ্যাতি। আসলাফ ও আকাবির বলতে কী? আমরা কি বুঝি না? হযরত মুহতামিম সাহেব হুজুর রাহ. আজ আর দুনিয়াতে নেই, তার প্রশংসাগীতিতে নারাজি অসন্তুষ্টি এবং বিরক্তির কোনো ভয় নেই। তাই আজ সকলেই মুখ খুলে বলতে পারবেন, এই মহান ব্যক্তির স্তবস্তুতি। ভাষার ঝংকার ছুটিয়ে তাঁর উচ্চমাকামের পরিচয় দিতে আজ আর কোনো বাধা নেই। উচ্চমর্যাদার পরিচয় দিতে আজ আর আসবে না কোন বাধা।
আসলাফ ও আকাবিরের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা ও অনুসরণ মুক্ত চিন্তার এবং স্বাধীন চলার পরিবর্তে তিনি আসলাফ ও আকাবিরের প্রতি শ্রদ্ধাসহকারে তাঁদের জীবনকে সামনে রেখে চলতেন। প্রতিটি কাজে আকাবিরের নজির উপস্থাপন করতেন এবং সে পথে চলতেন। কোনো সমস্যা দেখা দিলে তাঁদের জীবন থেকে সমাধান খুঁজে বের করতেন।তাঁর জীবনধারায় মন মুয়াফিক চলার সামান্য প্রবণতাও ছিল না; বরং রাসুলে করিম সা. এর সুন্নতের পাবন্দি ছিল তাঁর স্বভাবজাত। সুন্নতের অনুসরণ অনুরকরণ ছিল অঙ্গ ভূষণ
বিনয় ও নম্রতা
হযরতের বিনয় ও নম্রতার বিভিন্ন অবস্থা ও ঘটনাবলি আমাদের শিক্ষার বস্তু। ছাত্র-শিক্ষক এবং সাধারণ জনগণ তাঁকে শ্রদ্ধা করত। সমীহ করত এজন্য নয় যে তিনি মাদরাসার মুহতামিম সাহেব; বরং তিনি সবাইকে শ্রদ্ধা এবং সমীহ করতেন তাই তারাও তাঁকে শ্রদ্ধা করত। চলার সময় বেশীরভাগ তিনি পিছু পিছু চলতেন। গ্রামের উশৃংখল যুবকরা ও তাঁর সামনে গেলে আদবে নুয়ে পড়ত। কারও সাথে কোনো শক্ত কথা বলতেন না; হাস্যেজ্জ্বল মহব্বতপূর্ণ কথায় অবাধ্য ছেলেটিও পরম বাধ্য হয়ে যেত। ছাত্ররা তাঁর সামনাসামনি হলে তাঁকে ভয় করত। শাসনের ভয় নয়; বেয়াদবীর ভয়—নাজানি আমা থেকে কথায় কাজে কোনো বেয়াদবি প্রকাশ পেয়ে যায়। তাই সবচেয়ে বড় বেআদব ছেলেটা সবচেয়ে বড় আদবওয়ালা হয়ে যেত। মাদরাসার ছোট ছোট ছেলেরা ছিল তাঁর ব্যাপারে বেখবর। কারণ এখান থেকে কোনো ধমক বা শাসন পাওয়ার আঙ্ককা নেই। অনেকে তিনি যে মুহতামিম, বড় হুজুর একথাও জানত না। একবার বাৎসরিক জলসার দিন হুজুরের সঙ্গে আমরা কয়েকজন শাগরিদ দফতরে বসে আছি। এমন সময় তিনি চায়ের প্রয়োজনবোধ করলে কাউকে না পেয়ে বারান্দা থেকে ছোট একটা ছেলেকে ডেকে আনলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন তুমি কোথায় পড়? সে বলল, এই মাদরাসায়। হুজুর বললেন, আমাকে চিন? সে বলল জী-না। হুজুর বললেন, মেহমানখানায় গিয়ে বলবে মুহতামিম সাহেব বলেছেন দফতরে কিছু চা-নাশতা দেওয়ার জন্য। আমরা হাসি সামলাতেও পারি না, আবার হাসতেও পারি না। কারণ জীবন্ত আদবের সামনে বেআদবি করা কোনো সহজ কথা নয়। তিনি যে মাদরাসার প্রধান এবং মুহতামিম এ কথা তাঁর অন্তরে ছিল না। তিনি বলতেন, আমার সম্পর্ক তো পাথরওয়ালা, বালুওয়ালা ইটওয়ালা এবং মিস্ত্রীদের সঙ্গে। কোনো সময় ছাত্রদের নিকট থেকে মাদরাসা বন্ধের কথা জেনে নিতেন, জিজ্ঞেস করতেন কয় দিনের বন্ধ। তিনি ছিলেন মাটির মানুষ, নফসানিয়াতের লেশ-গন্ধহীন এক ব্যাক্তি।
দোষ-গুণ হয়ে যেত
প্রয়োজনের তাগিদে কারো কোনো দোষ বা অবস্থা বয়ান করতে গেলে তিনি এমন ভাষায় কথা বলতেন যে, সেটা ওই ব্যক্তির দোষ নয়; বরং গুণই মনে করা হত। একদিনের ঘটনা—মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় ভুলে তিনি অন্যের জুতা পায়ে করে নিয়ে যান। কামরায় যাওয়ার পরে বিষয়টি বুঝতে পারেন। এর পর তিনি ওই জুতাটি পায়ে করে নয়; বরং হাতে করে কামরায় ঘুরে এটা পরিবর্তন করেন। এ জাতীয় ঘটনা তাঁর জীবনে এক-দু’টি নয়; ভূরি ভূরি।
তিনি সবকিছুই করতেন কিন্তু কিছুই না
কোনো ভালো কাজ করার পর স্বগর্বে নিজের দিকে এর নিসবত করা আজ কাল একটা সাধারণ ফ্যাশন। কিন্তু হযরত মুহতামিম সাহেব ছিলেন এর ব্যাতিক্রম। সবকিছুই তিনি করতেন, কিন্তু নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন। কাজের নিসবত করতেন নিজের কোনো উস্তাদ বা মুরব্বির দিকে। হযরত শায়খুল হাদিস আল্লামা বাইয়মপুরি রাহ. কাফিয়ার শরাহ ইযাহুল মাতালিব লিখে নিসবত করলেন নিজের উস্তাদ মাওলানা মশিয়ত উল্লাহ সাহেবের দিকে। শায়খুল হাদিস মাওলানা যাকারিয়া সাহেব আবু দাউদ শরিফের শরাহ বজলুল মজহুদ লিখে নিসবত করলেন স্বীয় শায়খ মাওলানা খলিল আহমদ সাহরানপুরি রাহ. এর দিকে। এমনি হযরত মুহতামিম সাহেব রাহ. মাদরাসার দালান ভবন সবই নিজে করেছেন, কিন্তু নিসবত করতেন কোনো না কোনো মুরব্বি এবং দেশবাসীর দিকে। এটা তাঁর কোনো লৌকিকতা নয় বরং আসলাফ ও আকাবিরের অনুসরণ। নিজেকে লুকিয়ে রাখার স্বভাবজাত গুণ। শুধু এটাই নয়; প্রত্যেকটি কাজে তাঁর ছিল একই অবস্থা।
ময়দানে কামালতের গহীন সমুদ্রে নীরব পদচারণা
ইলমে জাহেরি সমাপ্ত করার পর তিনি শায়খুল আরবে ওয়াল আজম, শায়খুল ইসলাম কুতবুল আলম হযরত মাদানি রাহ. এর খলিফা মাওলানা শায়খ আবদুল মতিন ফুলবাড়ি রাহ.‘র নিকট তরিকায়ে চিশতিয়া সাবেরিয়া, তরিকায়ে কাদেরিয়া তরিকায়ে মুজাদ্দেদিয়া, নকশবন্দিয়া ও তরিকায়ে সুহরাওয়ার্দিয়ার উপর বায়আত হন। ইলমে মারিফতের অবস্থা এমনিতেই লুকানো তার সঙ্গে তিনির স্বভাবজাত আত্মগোপনের তবিয়ত। এ অবস্থায় তাঁর হালাত সম্পর্কে জানা-বুঝা বিরাট কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে একটা কথা প্রচলিত ছিল। ليل أبي حنيفة للعبادة، ونهار أبي حنيفة للإفادة “ইমাম আবু হানিফা সারারাত এবাদত করতেন এবং দিনের বেলায় ইলমের খেদমত আঞ্জাম দিতেন।”
হযরত মুহতামিম সাহেব রাহ. ফজরের পর চাঁদা আদায়ের জন্য বের হতেন এবং প্রায় একাই যেতেন। নিতান্ত প্রয়োজনবোধে কাউকে সঙ্গে নিতেন। ১০/১১টায় মাদরাসায় ফিরে এসে নির্ধারিত সবক পড়াতেন এবং আনুসাঙ্গিক কাজকর্ম করতেন। দিনের বেলায় পাঁচ ওয়াক্তের নামাযে জামাতে পড়ার সাথে সাথে প্রয়োজনবোধে হালকা তিলাওয়াত করতেন। রাত্রের অনুকারই ছিল তাঁর প্রেম খেলার সময়। মসজিদের হুজরায় থাকতেন, বড় ফ্লাস্কে রাত্রের ওযুর জন্য গরম পানি রাখতেন। হালকা নিদ্রা, নামায, তিলাওয়াত, যিকর এবং মুরাকাবা, দুয়া, কান্নাকাটির ভিতর দিয়েই রাতের অন্ধকার শেষ হতো। নামাযে ফজর নিজেই সুন্নত কিরাত দিয়ে অত্যন্ত সুললিত কণ্ঠে নিজেই পড়াতেন। তাঁর কুরআন তিলাওয়াত ছিল খুবই চমৎকার। রাতের বেলায় তিনি বেশি বেশি তিলাওয়াত করতেন। মাওলানা শায়খ মুস্তাকীম আলী আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের মুহাদ্দিস, আমারও শ্রদ্ধেয় উস্তাদ একজন উঁচুদরের আলিম ও কামিল ব্যক্তি। তিনি বলেন, একরাত্রে তিনি এবং হযরত মুহতামিম সাহেব রাহ. মাদরাসার দফতরে আরাম করেন। মুহতামিম সাহেব সারারাত তিলাওয়াত করেন। তাহাজ্জুদের সময় তিনি হযরত মুহতামিম সাহেবকে বলেন, হুজুর এভাবে সারারাত তিলাওয়াত করলে দিনের বেলায় মাদরাসার কাজ করবেন কিভাবে? হযরত জবাব দিলেন, সকালে একটু ঘুমানো যাবে। কিন্তু রাত্রে তিলাওয়াত না করলে সকালে ঘুম আসবে না। এক রাতের অবস্থা থেকে অন্যান্য রাত্রের অনুমান করা যাক। তাঁর মধ্যে যে এশকের ফোয়ারা ছিল, তা বুঝা যেত না। যেভাবে বুঝা যেত না হযরত শায়খে কৌড়িয়া রাহ. এর অবস্থা।
মাদরাসা পরিচালনার ক্ষেত্রে কঠিন কঠিন সমস্যা আসত কিন্তু তাতে তিনি পেরেশান হতেন না। কারণ তাওয়াক্কুলের মাকামে ছিল তাঁর নীরব অবস্থান। রেযা ও তাসলিমের হালাত তাঁর বাহ্যিক হালাতকে স্বাভাবিক করে দিত। ফিতনার দাউ দাউ আগুন তাঁর তাহাজ্জুদের চোখের পানি দ্বারা নিষ্প্রভ হয়ে যেত।
ছোট সাহেবজাদা মাওলানা মাহমুদ হাসান বলেন, ৪/৫ বৎসর অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে অবস্থান করেন, এ সময় বসে বসে এবং যখন তাও সম্ভব হতো না শুয়ে শুয়ে তিলাওয়াত করতেন দৈনিক ৪/৬ পারা। শেষ পর্যায়ে যখন তাও মুশকিল হয়ে গেল তখন আমি বা পরিবারের কেউ পারা ধরতেন এবং তিনি তিলাওয়াত করতেন। যখন তাও অসম্ভব হয়ে গেল তখন কাছে বসে আমি তিলাওয়াত করে শুনাতম।
হযরত বায়মপুরি রাহ. এর ঘটনা
১৯৭০ ইংরেজিতে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের অধীনে জাতীয় পরিষদের (Pakistan National Assembaly) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি হযরত মুহতামিম সাহেবের উস্তাদ এবং ওই নির্বাচনে বিয়ানীবাজার-কানাইঘাট নির্বাচনী এলাকার প্রার্থী বিধায় নির্বাচনী প্রচারকল্পে আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর তশরিফ আনেন এবং রাত্রে মসজিদে অবস্থান করেন। তিনি ছিলেন কুরআনে করীমের আশিক। যে এলাকায় যেতেন সে এলাকায় যারা ভালো হাফিয এবং কারী হতেন তাদেরকে দিয়ে তিলাওয়াত করাতেন। কোনো কোনো আয়াত বারবার পড়াতেন। ক্রন্দন করতেন। এতে তাঁর মধ্যে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো মানুষও তাঁর সাথে আত্মহারার মতো ক্রন্দন করত। মুহতামিম সাহেব রাহ. সেদিনও ফজরের নামায পড়ান। প্রথম রাকাতে সুরায়ে কিয়ামা, দ্বিতীয় রাকাতে সুরায়ে দাহার পড়েন। সুললিত কণ্ঠের তিলাওয়াত শুনে হযরত বায়মপুির রাহ. আত্মহারা হয়ে যান। সালাম ফিরানোর পর তিনি বললেন, “আবদুল হাই! তোর এত মজার তিলাওয়াত! তুইতো আমাকে ফেলে দিয়েছিলে।” তারপর আবার তিলাওয়াত করান। এতে এক ভাবের মজলিস কায়েম হয়ে যায়। শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানি রাহ. এর খলিফা মাওলানা শায়খ তজম্মুল আলী রাহ. যিনি লাউড়ির পীর সাহেব নামে পরিচিত। বাড়ি পালকোনায় (প্রায় ৩ কি.মি. দূরে)। বাড়িতে এলে অনেক দূর হেটে ফজরের নামাযে মাঝে-মধ্যে আসতেন। হুজুর তাঁকে নামায পড়ানোর কথা বললে, তিনি বলতেন, আমি নামাযে তোমার তিলাওয়াত শোনার জন্যই এসেছি। সাহেবজাদা মাওলানা মাহমুদ হাসান বলেন, অসুস্থ থাকা অবস্থায় তিনি রাত্রি বেলায় প্রায় সারারাতই জাগ্রত থাকতেন এবং ধীরে ধীরে যিকির করতেন। কোনো মেহমান গেলে মেহমানদারির শক্ত খবর নিতেন। আলিম উলামা গেলে খুশি হতেন বেশি। তাদের হালপুরসি করতেন। বিভিন্ন মাদরাসার খবর নিতেন এবং সকল দ্বীনি মাদরাসার ভালোমন্দ খবর নিতেন। সকল দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের জন্য দুয়া করতেন। আসলাফ ও আকাবির বুযুর্গানে দ্বীনের আলোচনা শুরু হলে তিনি যেন সুস্থ হয়ে যেতেন। চলার সময় নিচের দিকে চোখ রেখে চলতেন, মনে হত যেন তিনি “মলকায়ে ইয়াদ দাশতের” ভিতর দিয়ে চলছেন । আবার কারো সাথে সাক্ষাৎ হলে আগে সালাম করতেন এবং অত্যন্ত হাস্যেজ্জ্বল মুখে হালপুরসি করতেন। কোনো কোনো সময় নিজের খাতিমা বিল ইমানের জন্য দুয়া চাইতেন।
আমানতধারী, আর্থিক দৈন্যতা ও আত্মত্যাগ
আরবিতে একটি প্রবাদ আছে تعاملوا كالأجانب، وتعاشروا كالأقارب অর্থাৎ পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে লেনদেন করবে অপরিচিতের ন্যায় আর অজানা ব্যক্তির সঙ্গেও আচরণ করবে আপনজনের মতো। এ প্রবাদটি হযরতের জীবনের একটি জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। মাদরাসার তহবিল সংরক্ষণে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। খাতা-পত্রের হিসাবের যথেষ্ট স্বচ্ছতা থাকার পরও তিনি বিভিন্ন ফাণ্ডের জন্যে পৃথক পৃথক থলে ব্যবহার করতেন এবং এক ফাণ্ডের টাকা অন্য ফাণ্ডে নিতেন না। একবার তাঁর হুজরা থেকে প্রায় ২৫ হাজার টাকা হারানো গেলে কয়েকদিন পর্যন্ত ক্রন্দন করেন আর বলেন, আমার নিজের গাফলতির কারণে সে টাকা হারিয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিজের পক্ষ থেকে সে টাকা ভর্তুকি দিয়েছেন। হিসাবপত্রের ব্যাপারে আমি নালায়েক তাঁর কাছ থেকে অনেক উপকৃত হয়েছি। একদিন তিনি বললেন, যে হাতে কলম থাকবে—সে হাতে টাকা থাকবে না। এর পর থেকে আমিও তাঁর এ নীতি মেনে চলি।
সংসার পরিচালনার ব্যাপারে তাঁর পৃথক কোনো আয়ের ব্যবস্থা ছিল না। তবুও তাঁর চালচলনে মোটেও অসচ্ছলতা প্রকাশ পেত না। মাদরাসার চাঁদা কালেকশনে অনর্থক খরচ করতেন না, ইসরাফ থেকে সর্বদা দূরে থাকতেন। মাদরাসার কালেকশনে তিনি কয়েকবার লন্ডন যান। কোটি কোটি টাকা মাদরাসার জন্য এনেছেন; কিন্তু নিজের জন্য কিছুই করেননি। একখানা ঘরও তৈরি করেন নি। নিজের দুই ছেলের মধ্যে কাউকে লন্ডনে নেওয়ার চিন্তাও করেন নি। শেষ জীবনে অসুস্থতার কারণে যখন ঘর বৈঠকি হয়ে গেলেন তখন খবর পেয়ে লন্ডন প্রবাসী শাগরিদরা কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে একখানা ঘর বানিয়ে দেন।
হযরত মুহতামিম সাহেব রাহ. পাঁচ ভাইদের সবচেয়ে বড়। পরিবারের দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। মসজিদের ইমামতি ও মাদরাসার শিক্ষকতাই ছিল তাঁর পেশা। এ সম্পর্কে সাহেবজাদা মাহমুদ হাসান বলেন, আমার ৩য় ও ৪র্থ চাচা (মাওলানা আবদুল হালিম ও মাওলানা আবদুল করীম রাহ.) ওই সময় আঙ্গুরা মাদরাসায় পড়তেন। এশার পর খাওয়া দাওয়া শেষ করে মসজিদের হুজরায় চলে আসতেন কিতাব বাইন্ডিং করার জন্য। পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য হালাল জীবিকার উদ্দেশ্যে এটাও ছিল হযরতের একটি আনুসাঙ্গিক কাজ। সাহেবজাদা মাওলানা মাহমুদ হাসান স্বীয় চাচার বরাত দিয়ে বলেন, “কিতাব বাইন্ডিং এর কাজে রাতে বেশি দেরি হয়ে গেলে তিনি বলতেন, এখানে শুয়ে পড়ো। মাহমুদ সাহেব বলেন, চাচাজান বলেছেন, আমরা দুভাই শুয়ে পড়তাম এবং মনে মনে ভাবতাম—দেখি ভাইজান কী করেন। শুয়ে শুয়ে দেখতাম, ভাইজান নামাযে দাঁড়িয়ে গেছেন।
কিতাব বাইন্ডিং এর সময় সুন্নতে নববির অনুসরণ
প্রত্যেক কাজ ডান দিক থেকে শুরু করা সুন্নত। কিতাব বাইন্ডিং এর সময়ও খেয়াল রাখতেন এবং ছোট ভাইদেরকেও শিখিয়ে দিতেন—আগে ডান দিকের কাজ সমাধা করতে হবে। আরবি লিখা কাগজ যেন বাংলা লিখা কাগজের নিচে না পড়ে।
পরিবারে কঠোর পর্দা ব্যবস্থা
আঙ্গুরা মাদরাসার নাজিমে তালিমাত, উস্তাদুল উলামা মাওলানা জিয়া উদ্দিন সাহেব যিনি বর্তমান মুহতামিম ও নাজিমে তালিমাত; হযরতের শাগরেদ ও কর্মজীবনের সবচেয়ে বড় সহযোগী বলেন, সাধারণ মানুষতো দূরের কথা আজকাল অতি নির্ভরযোগ্য আলিম উলামার পরিবারেও শরিয়তসম্মত পর্দার ব্যবস্থা পাওয়া কঠিন হলেও একান্নবতী পরিবারে হওয়ার পরও হযরতের পরিবারে পুরো শরিয়তসম্মত পর্দার ব্যবস্থা ছিল। পর্দার ব্যাপারে হযরতের নিজের কঠোর অবস্থানই ছিল এর বড় কারণ।
সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য
নাম আবদুল হাই, পিতা- মুনশি আবদুল হাসিব, মাতা- খুরশিদা খানম, গ্রাম- মাথিউরা বাহাদূরি বাড়ি, থানা- বিয়ানীবাজার, জেলা- সিলেট। ১৯৩২ইংরেজি ১১ই মার্চ মুতাবিক ১৩৩৮ বাংলার জৈষ্ঠ মাসে জন্ম।
শিক্ষা
১৯৩৮ সালে মাত্র ছয় বৎসর বয়সে হাফিয সায়ীদ আলী সাহেবের কাছে কুরআন শরিফ শিক্ষার মাধ্যমে পড়া শুনার সূচনা হয়। এর পর মাথিউরা ঈদগাহ পাঠশালায় ১ম ও ২য় মান, আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর পাঠশালায় ৩য় মান। এরপর দারুল উলুম দেউলগ্রাম মাদরাসায় পড়াশুনা করেন এবং সেখান থেকে গাছবাড়ি জামিউল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হয়ে ফাজিল ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। ১৯৫৪ সালে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে এশিয়ার শ্রেষ্ঠতম বিশ্ববিদ্যালয় খ্যাত ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করেন। কিন্তু আইনের জঠিলতার কারণে কয়েকমাস থাকার পর চলে আসতে হয়। এরপর দাওরায়ে হাদিস পড়ার জন্য ঢাকা লালবাগ মাদরাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৫৫ সালে তাকমিল ফিল হাদিসের সনদ লাভ করেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি ছিলেন প্রখর মেধাবী, চরিত্রবান, শান্ত স্বভাবের অত্যন্ত হুঁশিয়ার ও মিতব্যয়ী।
বিভিন্ন মাদরাসায় তাঁর উস্তাদগণের তালিকা
দেউলগ্রাম মাদরাসায় হযরতের উস্তাদগণ
১. জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম আল্লামা শিহাবুদ্দীন গোবিন্দশ্রী রাহ.
২. মাওলানা আবদুর রহিম শেরপুরি রাহ.
৩. মাওলানা ফযলে হক পাত্রমাটি রাহ.
৪. মাওলানা মুসাদ্দার আলী রাহ., আকাখাজানা
৫. শহীদ মাওলানা তাহির রাহ. মুহাম্মদপুরি
৬. মাওলানা আবদুল হালিম রাহ., প্রমুখ।
গাছবাড়ি মাদরাসায় হযরতের উস্তাদগণ
১. মাওলানা ইয়াকুব আলী রাহ.
২. মাওলানা সাঈদ আলী, চারাবই
৩. মাওলানা শফিকুল হক আকুনি রাহ.
৪. মাওলানা হাবিবুর রহমান রাহ. নয়াগ্রামি
৫. মাওলানা শাহরুল্লাহ রাহ., প্রমুখ।
দারুল উলুম দেওবন্দে হযরতের উস্তাদগণ
১. আওলাদে রাসূল সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানি রাহ.
২. মাওলানা মে’রাজুলল হক রাহ.
৩. মাওলানা সায়্যিদ হাসান রাহ.
৪. মাওলানা মুহাম্মদ হোসাইন বিহারি রাহ.
৫. মুফতি সাঈদ বিন মোবারক রাহ., প্রমুখ।
লালবাগ মাদরাসায় যাদের নিকট যে কিতাব পড়েন
১. মুজাহিদে আযম শামসুল হক ফরীদপুরি রাহ.‘র নিকট বুখারি শরিফ ১ম খণ্ড,
২. শায়খুল হাদিস আজিজুল হক দা.বা. ‘র নিকট বুখারি শরিফ ২য় খণ্ড,
৩. মাওলানা হোদয়াতুল্লাহ সাহেবের নিকট তিরমিযি শরিফ,
৪. মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জি হুযুর রাহ. ‘র নিকট নাসায়ি শরিফ,
৫. মাওলানা সানাহ উল্লাহ সাহেবের নিকট মুসলিম শরিফ,
৬. মাওলানা মুফতি আবদুল মুঈয রাহ. ‘র নিকট ইবনে মাজাহ পড়েন।
কর্মজীবন
আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর গ্রামের জামে মসজিদের ইমামতি এবং দারুল উলুম দেউলগ্রাম মাদরাসার শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৬ সন থেকে। ১৯৬১ সনে বিশেষ কারণে তদানীন্তন মুহতামিম মাওলানা শিহাব উদ্দিন রাহ. ও নাজিমে তালিমাত মাওলানা খলিলুর রহমান সাহেব রাহ.সহ মোট নয়জন শিক্ষক যার মধ্যে তিনিও ছিলেন চলে আসেন। কিছুদিন আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মসজিদে সবক চলে। গ্রামবাসীকে নিয়ে অনেক মিটিং এবং পরামর্শের পর মুহাম্মদপুর নিবাসী মরহুম হাজী আবদুল কাদির রাহ. সাহেব তাঁর বাড়ি থেকে অতি মূল্যবান ৩বিঘা জমি ওয়াকফ করে দেন। সেখানেই জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা শিহাব উদ্দিন রাহ. সাহেব ইনতেকাল করলে অনেক অনুরোধের পরও তিনি এহতেমামির দায়িত্ব কবুল করেননি। এরপর বর্তমান জামিয়া মাহমুদিয়া সুবহানীঘাট, সিলেটের প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম মাওলানা শফিকুল হক আমকুনি সাহেবকে ১৩৯৩ হিজরিতে মুহতামিম পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৩৯৯ হিজরিতে তিনি মাদরাসা থেকে অব্যাহতি নিয়ে চলে গেলে বাধ্য হয়ে তিনি এহতেমামের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্বপ্রাপ্তির প্রথম বৎসরই দাওরায়ে হাদিস খোলা হয়। টিনের পাকাঘর দোতলা বিল্ডিংয়ে রূপান্তরিত হয়। মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ও অগ্রগতি হয়। আযাদ দ্বীনি এদারা তথা মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে জামিয়ার একটি বিশেষ অবস্থান সৃষ্টি হয়।
নদী ভাঙ্গন
মাদরাসার সম্মুখ দিয়ে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে প্রবাহমান কুশিয়ারা নদীতে মাদরাসার বরাবরে ভাঙ্গন দেখা দেয়। মাদরাসার ভবিষ্যৎ আশংকাময় হয়ে পড়ে। দুয়া, খতম, কান্নাকাটি, জাহেরি তদবির, অজস্র বস্তা বালু নদী গর্ভে ফেলা হয়। কুতবে বাঙ্গাল শায়খে কৌড়িয়া রাহ. এসে দুয়া করেন। নদীর পার দিয়ে হাটেন কিন্তু আপাতত কোনো কিছুই কার্যকর হল না। মুহাম্মদপুর এবং তৎপার্শ্ববর্তী এলাকার বিরাটসংখ্যক লোক লন্ডন প্রবাসী। হযরত মুহতামিম সাহেব লন্ডন সফর করেন। সকলের সঙ্গে আলোচনার পর মাদরাসা স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। সকলের কাছ থেকে বিরাট অংকের চাঁদা আদায় করা হয়। আলহাজ শফিক উদ্দিন সাহেব বর্তমান নতুন মাদরাসা যেখানে আছে সেখানে ৪বিঘা জমি দান করেন এবং তৎসঙ্গে জনাব আবদুল খালিক কুটু মিয়া গোবিন্দশ্রী এক বিঘা, জনাব শফিক উদ্দিন সাহেব আধ বিঘা এবং মুনশি আবদুর রব সাহেবের ছেলে জনাব গিয়াস উদ্দিন গংদের এক পোয়া জমি নিয়ে নতুন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মাদরাসার স্থান এবং ভবনের মনোরম দৃশ্য দেখলে যে কোনো দর্শকের সৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু এসব কোন ইঞ্জিনিয়ারের ফর্মূলা অনুসারে নয়; বরং পরিকল্পনা ডিজাইন সবই হযরত মুহতামিম সাহেব রাহ. ’র। এই প্রচারবিমুখ, গুমনাম এই ফকির দরবেশের ভিতরে ভাষ্কর্য জ্ঞানের এই যে মেধা এটা না দেখলে বুঝার মতো নয়।
আসমানি ফয়সালার নতুন দিগন্ত উম্মোচন
বিরাট অংকের অর্থ ব্যয়ে নতুন মাদরাসা হয়ে গেল। এদিকে পুরাতন মাদরাসার ভাঙ্গন বন্ধ হয়ে গেল। হযরত শায়খে কৌড়িয়া রাহ. যেখান দিয়ে হেটে গিয়েছিলেন সে বরাবর এসে ভাঙ্গন রোধ হয়ে গেল। এরপর প্রতিবছর চর দিতে দিতে পাকার কাজের বালুও বের হওয়া শুরু হয়ে গেল। আল্লাহর কুদরতের কি অপার মহিমা মানুষের সাধ্য কি সেটা বুঝবে। ভাঙ্গন না হলে নতুন মাদরাসা তৈরি হওয়ার প্রশ্নই আসত না। মাদরাসার পুরাতন এবং নতুন উভয় ভবনই হযরত মুহতামিম সাহেবের নিজ হাতে স্বীয় পরিকল্পনা মতে তৈরি। নতুন মাদরাসার উত্তর পার্শ্বে কুরআনে করিমের একখানা পৃথক হিফজখানা তৈরির ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আমার বিশ্বাস আল্লাহ তাঁর মকবুল বান্দার সে ইচ্ছা অবশ্যই পূরণ করবেন, কিন্তু কার দ্বারা কাদের সাহায্যে হবে তিনিই ভালো জানেন।
শিক্ষাদান
কওমি মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব এমন একটি কঠিন কাজ, এর পেছনে যদি নৈতিক দায়িত্ববোধ, ধর্মীয় আদর্শের নীতি, দ্বীনি আবেগ এবং আখেরাতের অফুরন্ত সওয়াব ও তার সাথে সাথে আসলাফ ও আকাবিরিনের রেখে যাওয়া আমানতের পরিচর্চাবোধ না থাকত তবে কোনো আলিম বা শিক্ষিত মানুষ কওমি মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করত না। প্রত্যেক মানুষের জীবন চলার পথে যা কিছু প্রয়োজন এবং একটি ছোটখাট সংসার পরিচালনার ব্যাপারে যা জরুরী তার ন্যূনতম পরিমাণটাও সংকুলান করার ব্যবস্থা এখানে নেই। সংসারের কঠিন বোঝার কারণে তাকে পেরেশান হতে হয়। বউ বাচ্চার প্রয়োজন মিঠাতে না পারায় তাদের নিকট মাথা হেট করতে হয়, মা-বাপ এবং ভাই-বোনদের নিকট ছোট হতে হয়। অথচ তার অবস্থান সমাজে এক সম্মানজনক অবস্থানে। মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ব্যাপারে তাকে যে কঠিন বোঝা বহন করতে হয় তা একজন সাধারণ মানুষতো দূরের কথা উচ্চ থেকে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষেও চিন্তা ও ধারণা করার কথা নয়।
একজন মুহতামিমকে মাদরাসার জায়গা, ঘর-দরজা, কিতাবাদি, শিক্ষক-কর্মচারির মাসিক বেতন-ভাতা, ছাত্রদের বিনামূল্যের খোরাকি, গরিব এতিম ছাত্রদের বিভিন্ন খরচপত্রের ব্যবস্থা করতে হয়। অথচ সেটা সংকুলান করার জন্য তাঁর নিকট নির্ধারিত সামান্যতম ব্যবস্থাপনা নেই। মুহতামিম সাহেবের বাৎসরিক কয়েক লক্ষ টাকার বাজেট একটা খেয়ালীপনা এবং শূন্যে দড়ি বাধার ন্যায়; যার কোনো দিকে বেধে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। মানুষের কাছে যেতে হয়, দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয়। যা অনেকের নিকট আপাতত অপমানজনক মনে হয়। আবার যা হয় তাও প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে সামান্য হওয়ায় ছাত্র-শিক্ষকের নিকট ছোট হতে হয়। সর্বদা চিন্তিত থাকতে হয়, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চলতে হয়, চলতে চলতে ঘুমাতে হয়। তারপরও নিজের অক্ষমতাও অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়, বদনাম কুঁড়াতে হয়, অনেক সময় জবাবদিহি করতে হয়। পিঠের চামড়া শক্ত করতে হয়, কানে শুনেও না শুনার ভান করতে হয়। কর্জ করতে হয়, কর্জ আদায় করার জন্য নিজের কোনো জিনিস বা জমিজমা বিক্রি করতে হয়। অনেকসময় নিজের ঘরে চাল-ডাল থাকে না এরপরও বোর্ডিংয়ে ছাত্রদের খোরাকির ব্যবস্থা করতে হয়। কারুর উপর চাপ দেওয়া যাবে না, যা করবেন শুধু অনুনয় বিনয়।
প্রশ্ন হচ্ছে এরপরও আলিম-উলামা এসব কিভাবে সংকুলান করেন এবং এত বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিভাবে গড়ে তুলেন? দেখে মনে হয় দেশীয় সরকারের পাশাপাশি আরেক সরকার। এর জবাব দু’ধরনের। একটি হচ্ছে তারা এ পদ্ধতিরই সৃষ্টি (ঞযবু ধৎব ঃযব ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ ড়ভ ঃযরং ংুংঃবস) তাই সবকিছু সহ্য করা তাদের স্বভাবজাত। দ্বিতীয়ত এক মহান তথা জগতের শ্রেষ্ঠতম আদর্শের লালন এবং বিস্তারের নেশাকে নিজের জীবনের ব্রত বানিয়ে নেওয়ার কারণে কষ্ট আনন্দে, অপমান গৌরবে পরিণত হয়ে যায়। আম্বিয়ায়ে কেরাম, পূর্বসূরি আসলাফ-আকাবিরিন ও বুযুর্গানে দ্বীনের ত্যাগ তিতিক্ষা, তাদের মধ্যে রুহানি শক্তির বিকাশ ঘটায়, অভাবের মধ্যে স্বচ্ছলতার আনন্দ সৃষ্টি করে, ফকিরির মধ্যে আমিরির নমুনা দান করে সর্বোপরী পরকালের অপরিসীম সাফল্য ও মর্যাদার সুসংবাদ সকল মুসিবতের পাহাড়কে তাঁদের জন্য ফুলবাগান বানিয়ে দেয়। কওমি মাদরাসায় মুহতামিমির দায়িত্ব সম্পূর্ণ রূপে শূন্যে দড়ি বাঁধার মতো একটা অকল্পনীয় দূরুহ দায়িত্ব। এ দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে গিয়ে অনেক উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন অলিমও রীতিমত সবক পড়াতে পারেন না। ইলমের চর্চা থেকে বঞ্চিত থাকেন। কিন্তু হযরত মুহতামিম সাহেব রাহ. মুহাম্মদপুর মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, গঠন ও পরিচালনার সাথে সাথে আরও কয়েকটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব আন্জাম দেওয়ার সাথে সাথে শামাইলে তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, মিশকাত, বায়যাবি, শরহে আকাঈদে নাসাফি, হেদায়া ইত্যাদি কিতাব খুবই দক্ষতার সাথে পাঠদান করেন।
হাপানির মতো একটি কঠিন রোগ ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। এরপরও মাইলের পর মাইল পায়ে হেটে মাদরাসার জন্য চাঁদা কালেকশন করেছেন, বার বার লন্ডন ও সফর করেছেন।
অন্যান্য সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ড
আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদরাসার পাশাপাশি তিনি বিয়ানীবাজার দারুস সুন্নাহ মুরাদগঞ্জ টাইটেল মাদরাসা, মাথিউরা দারুল কুরআন মাদরাসা, আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মহিলা মাদরাসা, ফেঞ্চুগঞ্জ দারুল কুরআন মাইজগাঁও মাদরাসাসহ সুপাতলা জামে মসজিদ জকিগঞ্জ জিয়াপুর মসজিদ এবং আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদরাসার বিশাল মসজিদ তাঁরই বরকতময় হাতের অক্ষয় কীর্তি। তিনি সিলেট তানযীমুল মাদারিসের প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সভাপতি, আশ-শিহাব পরিষদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর গ্রামের নতুন জামে মসজিদ তিনি যে মসজিদের কর্মজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইমাম, তারই চেষ্টার ফসল। আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর গ্রামের মাঝখান দিয়ে প্রবাহমান খালের উপর গ্রাম থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে নিজে পুল দিয়ে চলাচল এবং মুসল্লিদের আসা যাওয়ার ব্যবস্থা করতেন।
শেষ বিদায়
সারা জীবন দুনিয়ায় থাকার পর শেষ বিদায়ের সময়টা মানুষের জীবনের সার সংক্ষেপ, কর্মময় জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। পরবর্তীদের জন্য গন্তব্যের রাজপথের দিশারি। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ রাহ. লিখিত ‘মউত কি দরওয়াজে পর ইনসানিয়াত’ (মৃতুর দুয়ারে মানবতা) জীবন্ত আকারে এ জিনিসটি বুঝা যায়।
মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবি রাহ. এ জাতীয় অনেক ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, জীবনের শেষ মুহূর্তে বিদায়ের যে পুণ্যময় হালাত মুসলিম মনীষীদের জীবনে দেখতে পাওয়া যায় এবং তাঁদের ভক্তরা যেভাবে একে কলমবন্দ করেছেন, কোনো অমুসলিম মনীষীর শেষ বিদায়ের সময়কার হালত কোনো লেখক লিপিবদ্ধ করেননি। আর নাই বলেই করেন নি। তারিখে দাওয়াত ও আজিমতে তিনি হযরত শরফ উদ্দিন ইয়াহইয়া মুনিরি মখদুমে বিহারি রাহ. এর শেষ বিদায়ের বর্ণনা হযরত মখদুমের জনৈক ভক্তের লিখা কয়েক পৃষ্ঠাব্যাপী বয়ান হুবহু নকল করেছেন তা পড়লে মুসলমান কেন অমুসলমানের মনেও স্পন্দন সৃষ্টি করে। ফজর থেকে এশা পর্যন্ত ভক্তদেরকে ওসিয়ত, নসিহত করতে ও দুয়া দরূদ কলমাজাত এস্তেগফার তসবিহাত পড়তে পড়তে সর্বশেষ কুরআনের আয়াত لاخوف عليهم ولا هم يحزنون অর্থাৎ “কোন ভয় নেই, নেই কোনো দুঃখ” পড়তে পড়তে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। যেন বেহেশতের অনাবিল সুখ শান্তি দেখে দেখে বিদায় নিয়েছেন।
আসুন আমাদের শায়খ আবদুল হাই রাহ.এর শেষ বিদায়ের হালতটাও একবার দেখে নিই। ২০০৫ সনের ২৬শে এপ্রিল, বুধবার, সকাল ১১টার দিকে নতুন মাদরাসার সামনের রাস্তায় হোচট খেয়ে মারাত্মক আঘাত পান। অনেক চিকিৎসার পরও সুস্থ হননি। কয়েকদিন চলা-ফেরার পর শয্যাশায়ী হয়ে যান। শয্যাশায়ী অবস্থায়ই বাকি দিনগুলো কাটে।সাহেবযাদা মাওলানা মাহমুদ হাসান এর বর্ণনা। কিছু দিন বসে বসে নামায আদায় করার পর শুয়ে শুয়ে নামায আদায় করতেন। নামায পড়ার সাথে সাথে শুয়ে শুয়ে দৈনিক ৪/৫ পারা তিলাওয়াত করতেন। নিজে কুরআন শরিফ ধরতে পারতেন না; পরিবারের অন্য কাউকে ধরে রাখতে বলতেন। আর তিলাওয়াত করতেন। প্রায় সারারাত্রই জাগ্রত থাকতেন এবং যিকির করতেন কখনও জোরে কখনও আস্তে। এ অবস্থায়ই মেহমানদের খবরা খবর রাখতেন। আলিম-উলামা গেলে খুশি হতেন। আসলাফ ও আকাবিরিনের আলোচনা হলে বেশি খুশি হতেন। মনে হত যেন তিনি সুস্থ হয়ে গেছেন। নিজ মাদরাসা ও অন্যান্য মাদরাসার খবর নিতেন, সকল দ্বীনি মাদরাসার জন্য আবেগভরা ভাব নিয়ে দুয়া করতেন। সব কাজে ইত্তিবায়ে সুন্নতের খেয়াল রাখতেন। কাপড় হাটুর উপরে ওঠেন গেল কি না? বাথরুমে যাওয়ার সময় কাপড় ঠিক আছে কি না? মাথায় টুপি আছে কি না? ডান পা আগে গেল কি না? পায়ে তেল দেওয়ার সময় আগে ডান পায়ে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা বলতাম, বাহরে বাহ সব কাজে যেন সুন্নাত না হলে না হয়।
এরপর সময় যখন ঘনিয়ে এল। ২৫ ফেব্র“য়ারি ২০১০ইং বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রে অস্থিরতা আরম্ভ হয়। মাগরিবের নামায আদায় করে শুয়ে শুয়ে নিজের ইচ্ছামতো নামাযের জন্য হাত বাঁধতে থাকেন এরপর এশার নামাযান্তে কিছু নফল নামায পড়ে সবাইকে ডাকেন, শেষ ওসিয়ত করেন। পরিবারের সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। রাত ১২টার দিকে হাত বাঁধেন আর ছাড়েন। প্রায় আড়াইটার দিকে দুনু হাত দিয়ে মুখ মুছতে থাকেন। আমি বললাম, আব্বাজান কোনো কষ্ট হচ্ছে না কি? নতুবা এমন করছেন কেন? তিনি বললেন, কথা বলো না। হযরত নবীয়ে করীম সা. এর সাথে আমার মোলাকাত হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রায় ৩টার দিকে তাঁর মধ্যে অন্যমনষ্কতা এসে যায়। আর কোনো কথা বলেন নি। এভাবে ভাবের জগতে বিচরণ করতে করতে পরদিন ২৬ ফেব্র“য়ারি ২০১০ইংরেজি মোতাবিক ১১ই রবিউল আউয়াল ১৪৩১ হিজরি রোজ শুক্রবার ১.১০ মিনিটের সময় কালেমায়ে শাহাদত পড়তে পড়তে শেষ বিদায় নেন।
পরিবার পরিজন
হযরত মুহতামিম সাহেব রাহ. জীবনে দু’টি বিবাহ করেন। প্রথম বিবাহ জকিগঞ্জ থানাধীন বারহাল ইউনিয়নে খিলগ্রাম নিবাসী জনাব আবদুল লতিফ সাহেবের মেয়ে ও শায়খুল হাদিস মাওলানা আবদুল কুদ্দুস সাহেবের বোন জমিলা খাতুনকে। এ স্ত্রীর গর্ভে এক মেয়েসন্তান জন্মগ্রহণ করেন, বর্তমানে তিনি বিবাহিতা ও আমেরিকা প্রবাসী। কোনো কারণ বশত প্রথম স্ত্রীকে তালাক দেন। দ্বিতীয় বিবাহ করেন বিয়ানীবাজার থানাধীন পূর্ব মুড়িয়া ইউনিয়নের জনাব মৌলবি নাসির আলী সাহেবের মেয়ে হামিদা বেগমকে। তার ঔরসে দুই ছেলে (মৌলবি হোসাইন আহমদ ও মাওলানা মাহমুদ হাসান) এবং দুই মেয়ে (হাজেরা বেগম ও ফাতেহা বেগম) জন্মগ্রহণ করেন।
পবিত্র হজ্জ পালন:
তিনি মোট চারবার হজ ও একবার ওমরাহ পালন করেন।
নামাযে জানাযা ও দাফন
ইন্তেকালের পরদিন ২৭ ফেব্র“য়ারি ২০১০ইংরেজি, শনিবার পি.এইচ.জি হাই স্কুল মাঠে বেলা ১১ ঘটিকায় নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। নামাযে জানাযা পড়ান হযরতের ছোট সাহেবজাদা মাথিউরা দারুল কুরআন মাদরাসার উস্তাদ মাওলানা মাহমুদ হাসান। জানাযা শেষে তাঁর হাতেগড়া প্রাণপ্রিয় জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের সম্মুখস্থ মাঠের উত্তর পূর্ব দিকে তাঁকে সমাহিত করা হয়। জানাযায় হাজার হাজার মানুষের মধ্যে আলিম-উলামার সংখ্যা ছিল বেশি। এটাও তাঁর প্রচার বিমুখতার একটা স্বাক্ষর।
উপসংহার
কুতবে রব্বানি মুহতামিম সাহেব রাহ. সম্পর্কে কয়েকটি লাইন লিখতে পেরে আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিনের শুকরিয়া আদায় করছি। যদিও এ কথার উপর আমি শতভাগ নিশ্চিত যে হযরতের জীবনী সম্পর্কে যারাই লিখবেন তাঁর মধ্যে অধমের লেখাটি হবে সবেচেয়ে নিুমানের এবং এ পবিত্র ব্যক্তির যথার্থ মূল্যায়ন করতে না পারার কারণে তা হবে বেয়াদবির শামিল। কারণ আমি এমনিতেই তাঁর সাথে অনেক বেয়াদবি করেছি। বিশেষত ফারিগ ছাত্রদের বায়আত করার জন্য তাঁকে শক্তভাবে বলতাম, কিন্তু হযরত নিজেকে লুকিয়ে রাখার স্বভাবজাত তবিয়তের কারণে এড়িয়ে যেতেন। তবে শেষ দিকে যখন বায়আত করতে শুরু করলেন তখন শুনে খুশি হলাম। অসুস্থ অবস্থায় দাওরায়ে হাদিসের ছাত্ররা তাঁর বাড়িতে যেতেন এবং বসে বসে দু’চার সবক পড়াতেন ও বায়আত করতেন। কোনো কোনো সময় জযবার অবস্থায় অনেক লম্বা তাকরির করে ফেলতেন।
জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের ৫০ বছর পূর্তি ও দস্তারবন্দি মহাসম্মেলন উপলক্ষ্যে আবনা ও ফুযালা সম্মেলন আহবান করা হয়। আমি সে বৈঠকে হাজির থাকতে পারি নি। সেখানে দস্তারবন্দি সম্মেলনের মূল স্মারকের সাথে হযরত মুহতামিম সাহেব রাহ.‘র জীবনীর উপর আরেকটি স্মারকগ্রন্থ বের করার সিদ্ধান্ত হয় এবং এতে লেখা দেওয়ার জন্য বিভিন্নজনের নাম উল্লেখ করা হয়। মাদরাসার নাজিমে তালিমাত এবং বর্তমান মুহতামিম এ অধমসহ হাজারো উলামায়ে কেরামের উস্তাদ মাওলানা জিয়া উদ্দিন সাহেব দামাত বারাকাতুহু সর্বপ্রথম অধমের নাম উল্লেখ করেছেন শুনে আমি একেবারে হতচকিত হয়ে গেলাম। কারণ তাঁর পক্ষ থেকে নাম লওয়ার অর্থ তাঁর হুকুম। আবার হুকুম পালন করার মতো যোগ্যতা আমার নেই, অমান্য করার মতো হিম্মতও নেই। কারণ তিনি শুধু সবকের উস্তাদই নন বরং জীবনের অনেককিছুর জন্য তাঁর নিকট ঋণি। সংবাদ পেয়ে চিন্তা করতে লাগলাম, কী লিখব? কী করব? হঠাৎ বৃটিশ ভারতের ইন্ডিয়ান এশিয়াটিক সোসাইটির (Indian Asiatic Sosiety) ডাইরেক্টর ড. উইলিয়াম মুইর (Dr. William Mur) লিখিত লাইফ অব মুহাম্মদ গ্রন্থের ভূমিকার একটি কথা মনে পড়ে গেল। তিনি লিখছেন- “Life of Muhammad Form a long series But in which it would be honourable to find a place” অর্থাৎ মুহাম্মদের জীবনীগ্রন্থ অগণিত। নতুন করে জীবনীগ্রন্থ রচনা করে মুহাম্মদকে পৃথিবীর বুকে পরিচয় করানোর কোনো প্রয়োজন নেই, তবে মুহাম্মদের জীবনী লেখকদের মধ্যে শামিল হওয়াটা আমার জীবনের জন্য গৌরবের বিষয়। তাই আমিও একখানা জীবনীগ্রন্থ লিখে গেলাম।
এমনিভাবে আমিও চিন্তা করলাম—আমার লিখা হোক নিুমানের; কিন্তু সেই পবিত্র আত্মা সম্পর্কে যারা লিখবেন—আমিও তাদের মধ্যে শামিল হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারব। অন্যদিকে হযরত নাযিম সাহেবের সু-ধারণা ও নির্দেশের প্রতিপালন হবে। আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিনের রহমতের দরবারে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, তিনি যেন তাঁর সারাজীবনের খেদমাত কবুল করেন এবং তাঁকে মাফ করার সাথে সাথে জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা দান করেন এবং আমাদেরকে তাঁর রুহানি ফয়েয দিয়ে মালামাল করার সাথে সাথে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন! ছুম্মা আমিন!!
লেখক: জামিয়ার সাবেক শিক্ষার্থী, মুহতামিম, বাহরুল উলুম বালিঙ্গা মাদরাসা