মাহমুদ হাসান বিন আবদুল হাই রাহ. : যুগে যুগে এ নশ্বর পৃথিবীতে যাঁরা দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন, তাঁদের প্রথম সারির লোক ছিলেন হযরাত আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম। তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা.। যাঁর হাতে গড়ে ওঠেছিলেন হযরাত সাহাবায়ে কেরাম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারিতে ছিলেন তাবেয়ীন ও তাবয়ে তাবিয়ীন। এর পর আইম্মায়ে মুজতাহিদীন তথা সালাফে সালিহীন। যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে পৃথিবীর সর্বত্র দ্বীনকে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা কাসিম নানুতবি রাহ.’র আন্তরিক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে দারুল উলুম দেওবন্দ নামে একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। এই ধারাবাহিকতার একটি প্রতিষ্ঠান ‘জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর’। এ প্রতিষ্ঠানের পিছনে যাঁরা নিজের জীবনকে অকাতরে বিলীন করে দিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন পূর্ব সিলেটের গৌরব আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মরহুম মাওলানা শায়খ আবদুল হাই রাহ.। যিনি ছিলেন জমিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের দীর্ঘদিনের সফল মুহতামিম। যাঁর হাতে এ মাদরাসা ছাড়াও আরো অনেক মাদরাসা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।
জন্ম
হযরত শায়খ রাহ. সিলেট জেলার অন্তর্গত বিয়ানীবাজার থানাধীন মাথিউরা গ্রামের বাহাদুরি বাড়ির মুনশি মুহাম্মদ আবদুল হাসিব সাহেবের ঔরসে ও ধার্মিক মহিলা মুছাম্মাৎ খুরশিদা খানমের গর্ভে ১৯৩২ সালের ১১ই মার্চ মুতাবিক ১৩৩৮ বাংলার জৈষ্ঠ্য মাসে জন্মগ্রহণ করেন।
এ মহান বুযুর্গের সংসারজীবনের স্মৃতিময় কিছু খণ্ডচিত্র নিুে আলোচনা করা হল।
পরিবার-পরিজনের চোখে তিনি যেমন ছিলেন
শৈশবকালেই তাঁর মধ্যে চারিত্রিক আভিজাত্য, দুর্জয় মনোবল ও বুদ্ধিমত্তার ছাপ সুস্পষ্ট দেখা গিয়েছিল। যাঁর আলোচনা করতে গিয়ে আমার দাদিজি বলেন, আমার ছেলেকে কখনো কোনোদিন কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হতে দেখিনি। কোনোদিন তাঁর মুখে গালি গালাজ শুনিনি। এমনকি সমবয়সী ছেলেমেয়েরাও আমার ছেলের সাথে আলাদা ব্যবহার করত। আমার দাদার নিকট হতে তাঁর সম্বন্ধে বলতে শুনেছি, ‘আমার ছেলের মধ্যে সর্বাবস্থায় এমনসব গুণ পরিলক্ষিত হত যা আমার অন্য কোনো ছেলের মধ্যে দেখতে পাইনি। বিশেষ করে সুন্নাতে নববির অনুসরণের ক্ষেত্রে।’ আমার দাদিজি প্রায় বলতেন, ‘ছোটবেলায় আমি তাঁকে বিভিন্ন দিক দিয়ে যখন নসিহত করতাম তখন তোমার আব্বাজান তা অত্যন্ত মনোযোগসহকারে শুনতেন এবং পালনও করতেন। এমনকি পর্দা সম্বন্ধে বলার সাথে সাথে তা পালন করতে লাগলেন। যার কারণে গোটা পরিবার পর্দা পালনে সচেষ্ট হয়।’ আমার আম্মাজান বলেন, কোনোদিন আমার সাথে তোমার পিতার মনোমালিন্য হয়নি। কোনোদিন এ কথা বলেননি যে, এ কাজ কেন করলে না? বা এ কাজ কেন হয় নাই; বরং আমি কোনোদিন রাগ করলে তিনি হাসিমুখে তা বরণ করে নিতেন। আমার জীবনে যতদিন তাঁর সাথে কেটেছে ততদিন আমার জানামতে ইচ্ছা করে কোনো একটি সুন্নাত ছাড়েননি। পরিবারের কাজকর্ম কিভাবে করতে হয়, সে সম্বন্ধে আমার সাথে আলাপ করে আমাকে বিভিন্ন দিক দিয়ে পরামর্শ দিতেন। এমনকি গোটা পরিবারের কাজ কেমন করে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যায় সেক্ষেত্রেও পরিবারের সবাইকে নিয়ে পরামর্শের বৈঠক বসাতেন।
শায়খ রাহ’র পাঁচ ভাই ও এক বোন ছিলেন। আব্বাজান সবার বড় ছিলেন। ভাইয়েরা হলেন, মরহুম আলহাজ আবদুল হালিম; মরহুম আলহাজ মাওলানা আবদুল আলীম; মরহুম মাওলানা হাফিয আবদুল করিম ও আলহাজ হাফিয আবদুশ শাকুর সাহেব। বোন হলেন, মরহুমা মোছাম্মাৎ মায়ারুন্নেছা। আব্বাজান রাহ. তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাইয়ের উস্তাদ ছিলেন। তাঁরা বলেন, আমরা আমাদের শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের নিকট হতে আদব-আখলাক, বিশেষ করে পর্দার নিয়মানুবর্তিতা শিখেছি। আমরা তো তাঁকে উস্তাদের মতো সম্মান করতামই এমনকি পরিবারের সকল সদস্যও উস্তাদের মতো তাঁকে সম্মান করতেন। আমার বড় চাচা আলহাজ আবদুল হালিম বলেন, আমি আমার বড় ভাই হতে আড়াই বছরের ছোট ছিলাম বিধায় আমি তাঁকে পরিবারের সব কাজে কিছুটা সাহায্য করতাম ,আর্থিক সহায়তা করতাম, বিদেশ হতে টাকা পাঠাতে বিলম্ব হলেও তিনি কখনো আমাকে কটু কথা বলেন নাই। আমি তাঁকে অত্যন্ত সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ হিসাবে পেয়েছি। আমি তাঁকে অতি সম্মানের চোখে দেখতাম। আমরা পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে এত অধিক ঘনিষ্ঠতা ছিল যা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। আর এর পেছনে তাঁরই একক অবদান ছিল। আমার শ্রদ্ধেয় ছোট চাচা বলেন, আমার বড় ভাইকে সর্বক্ষেত্রে আমার পিতার স্থলাভিষিক্ত পেয়েছি। ছোটবেলায় তাঁর এসব গুণাবলি দেখে আপন মামা মৌলবি আবদুল কাইয়ুম রাহ. তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে যান এবং প্রাথমিক ইসলামি শিক্ষা দান করেন।
সমসাময়িক এক বুযুর্গের চোখে মরহুম শায়খ রাহ.
আমি আমার এক সাথী নিয়ে বিগত রামাযানের কয়েকদিন আগে কানাইঘাট থানাধীন তালবাড়ি নামক গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানকার দু’টি মাদরাসা ভ্রমণ করার পর আমার সাথী আমাকে শায়খুল হাদিস মাওলানা কুতবুদ্দিন (সাবেক মুহাদ্দিস সিলেট দরগাহ মাদরাসা) দা. বা. সহেবের বাড়ি নিয়ে গেলেন। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর তিনি আমার আব্বাজান সম্পর্কে আলোচনা করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে আমাকে উদ্দেশ করে বলেন, তোমার পিতা হিসেবে তোমার ধারণা কতটুকু তা আমি জানি না। তিনি ১৯৫৫ সালে ঢাকা লালবাগ কুরআনিয়া মাদরাসায় দাওরায়ে হাদিস পড়ার সময় আমার সাথে সবসময় চলাফেরা করতেন। তিনি একজন আদর্শবান এবং সচেতন লোক ছিলেন। তাঁর নিকট হতে কেউ এক টাকার অতিরিক্ত নিতে পারতো না এবং তাঁর কাছে কেউ এক টাকার পাওনাদারও হতো না। ছাত্রজীবনে তাঁর চাল-চলন দেখে উস্তাদবৃন্দ অভিভূত হয়ে বলতে শুনেছি “এ ছেলেকে মনে হয় আল্লাহ্ তায়ালা মূল গঠনকালে এমন সৎ স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।” তাঁর আরেকটি গুণ ছিল, কোনো শিক্ষক মাদরাসার কোনো ছাত্রের প্রতি কোনো কারণে বা কাজে অসন্তুষ্ট হলে সকল ছাত্রই তাঁকে মাধ্যম হিসাবে উস্তাদের নিকট নিয়ে যেতেন এবং তাঁরই সুপারিশে উস্তাদবৃন্দ খুশি যেতেন।
পরিবার গঠনে তাঁর অবদান
বিয়ানীবাজার থানাধীন মাথিউরা গ্রামে অবস্থানকালে পরিবার বড় হওয়ার দরুন জায়গার সঙ্কট দেখা দিলে ১৯৬৭ সালে তাঁরই দিক নির্দেশনায় দাদা-দাদির পরামর্শে বর্তমান সুপাতলা নামক গ্রামে সকলকে নিয়ে পাড়ি জমান। এখনাকার বাড়ির যাবতীয় কাজ-কর্ম ও গৃহ নির্মাণের দায়-দায়িত্ব আমার মেঝ চাচার ওপর অর্পিত হলেও আর্থিক যোগানের সিংহভাগ আমার বড় চাচা ও আব্বাজানের ওপর ছিল। বড় চাচা লন্ডন থেকে নিয়মিত টাকা পাঠাতে পারতেন না। তিনি বেশিরভাগ সময় তাবলিগ জামাতে কাটাতেন। তাই আর্থিক যোগানদানে আমার পিতার অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হত। এরই সাথে অন্য তিন চাচার লেখাপড়ার যাবতীয় খরচও আব্বাজানকেই চালিয়ে যেতে হত।
শায়খ রাহ. পারিবারিক জীবনে দু’টি বিবাহ করেন। প্রথম বিবাহ করেন জকিগঞ্জ থানাধীন বারহাল ইউনিয়নের খিলগ্রাম নিবাসী মরহুম আবদুল লতিফ সাহেবের মেয়ে ও ঢাকা দক্ষিণ মাদরাসার শায়খুল হাদিস মাওলানা আবদুল কুদ্দুস সাহেবের বোন মুছাম্মাৎ জামিলা খাতুনকে। পরে কোনো কারণে তাঁকে তালাক দিয়ে দিলেন। দ্বিতীয় বিবাহ করেন বিয়ানীবাজার থানাধীন পূর্ব মুড়িয়া ইউনিয়নের বড় হুদা নিবাসী জনাব মৌলবি নাসির আলী সাহেবের মেয়ে আমার শ্রদ্ধেয়া জননী মোছাম্মাৎ হামিদা বেগমকে।আমার পূর্বের মার গর্ভে এক ভাই ও এক বোন জন্মগ্রহণ করেন। ভাই’র নাম আবদুল আউয়াল যিনি জন্মের পরেই মারা যান। বোন হলেন মোছাম্মাৎ রাজিয়া বেগম। বর্তমানে তিনি বিবাহিতা ও আমেরিকা প্রবাসী। আর আম্মাজানের গর্ভে আমরা তিন ভাই ও সাত বোন জন্মগ্রহণ করি। তন্মধ্যে এক ভাই ও পাঁচ বোন ছোটবেলায় মারা যান। আমরা হলাম আলহাজ হোসাইন আহমদ, মাওলানা মাহমুদ হাসান, মোছাম্মাৎ হাজেরা বেগম ও মোছাম্মাৎ ফাতেহা খানম। বর্তমানে আমরা সবাই বিবাহিত।
হযরত শায়খ রাহ. ব্যক্তিগত দিক দিয়ে সাদাসিধে জীবন-যাপন করাকে ভালবাসতেন। অধিক ঝাঁক-জমক পছন্দ করতেন না। পরিবারের সকল সদস্যের সঙ্গে হাসি মুখে কতা বলতেন । ফলে সকলেই মুগ্ধ হয়ে যেত। প্রথম দিকে গোটা পরিবার পরিজনকে ইসলামি আদর্শে গড়ার লক্ষ্যে প্রতি মাসে তারবিয়াতি বৈঠক ডেকে সকলকে একত্রিত করে কখনো নিজে কুরআন-হাদিসের অমীয় বাণী শুনাতেন, আর কখনো অন্য কোনো বড় আলিমকে দিয়ে আলোচনা করাতেন। এ মেহনতের ফলেই আজ পরিবারের সকল সদস্য ইসলামি ধ্যান-ধারণায় গড়ে ওঠেন। যার নজির এখনো বিদ্যমান রয়েছে।
আমি আব্বাজানকে পর্দা পালনে এত কঠোর পেয়েছি যে, তাঁকে কখনো মুহাররামাত ছাড়া কারো সম্মুখে বের হতে দেখিনি। এমনকি আমার চাচারাও আমার মাতার সম্মুখে কখনো বের হননি। একান্ত প্রয়োজন হলে পর্দার আড়াল থেকে আলাপ কর তেন। তিনি আমাদের সকলকে সেভাবে চলার জন্য বারবার তাগিদ দিতেন। কাউকে তিনি অসতর্ক অবস্থায় দেখতে পেলে খুব রাগ করতেন। যার দরুন আজ এ পরিবারের সুনাম এতটুকু গড়িয়েছে। বাড়ির সব কাজ ব্যক্তিগত হউক বা পারিবারিক ভাইদেরকে নিয়ে পরামর্শক্রমে করতেন। তাঁরই পরামর্শে বাড়ির পার্শ্বে একটি জামে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। বাড়ির জমির ভাগ-বাটোয়ারা নিজ হাতে ভাইদেরকে নিয়ে করেন। নিজে কোনো প্রকার সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন না; বরং ভাইদের কোনো কষ্ট হচ্ছে কি না সে দিকে খুব লক্ষ্য রাখতেন। নিজে বড় হওয়া সত্ত্বেও ভাইদের মনে কোনো ধরনের কষ্ট দিতেন না। কোনো প্রকার বিপদ আসলে প্রথমে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বাড়ির সবাই তাঁর নিকট হতে পরামর্শ গ্রহণ করত। কেউ তাঁর নিকট কিছু চাইলে সাধ্যনুযায়ী সঙ্গে সঙ্গে তা দিয়ে দিতেন। এতে কোনো প্রকার কার্পণ্য করতেন না।
সুন্নাতে নববির প্রতি নজিরবিহীন আকর্ষণ
এ মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন সুন্নাতে নববির পূর্ণ আশিক। যা তাঁর কাজকর্ম থেকে অনুধাবন করা যায়। ছোট থেকে ছোট কাজে সুন্নাতের বর-খেলাপ করতেন না। তাঁর আলোচনা করতে গিয়ে একদিন আমার ছোট চাচা বলেন, ছোট বেলায় আমি ও আমার মেঝ ভাই মাওলানা আবদুল আলীম আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর গ্রামে ছিলাম। আমি পড়াশুনা করতাম উত্তর আকাখাজানা হাফিজিয়া মাদরাসায়, মেঝ ভাই পড়তেন দেউলগ্রাম মাদরাসায়। তার লজিং ছিল মসজিদের পার্শ্বে মরহুম আলহাজ আফতাব আলী সাহেবের বাড়িতে। আমরা উভয়ে তাঁর নিকট পড়াশুনা করার জন্য এশার পরে আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর জামে মসজিদে যেতাম। তখন আমাদের শ্রদ্ধেয় বড় ভাই সারাদিন মাদরাসার কাজকর্ম করার পরও পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে মসজিদের হুজরায় বই বাইন্ডিং এর কাজ করতেন। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে আমরা তাঁকে সাহায্য করতাম। বই বাইন্ডিং করার ক্ষেত্রে প্রথমে ডান দিকের কাজ, পরে বাম দিকের কাজ কিভাবে করতে হয়, কিভাবে রাখতে হয়, আরবি বইগুলো কিভাবে স্তর বিন্যাস করে রাখতে হয় তা আমাদেরকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতেন। তাঁর এমন কাজ দেখে আমরা মনে মনে ভাবতাম এতটুকু কাজে কি সুন্নাতের অনুসরণ করতে হয়? তারপর আমাদেরকে কাজে লাগিয়ে তিনিও কাজে লেগে যেতেন। এরপর গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে আমরা শুয়ে পড়তাম। তিনি কাজ শেষ করে রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর নিকট সেজদায় অবনত হয়ে যেতেন এবং স্বীয় মাদরাসার কল্যাণের জন্য অঝোর ধারায় কাঁদতেন। আমার আম্মাজান বলেন, বাড়িতে থাকাকালীন এতো ঝামেলার ভেতর দিয়েও আমার জানা মতে কোনো দিন তোমার পিতার কুরআন তিলাওয়াত, এশরাক, আওয়াবিন, তাসবিহ-তাহলিল এমনকি তাহাজ্জুদের নামাযও বাদ পড়ে নাই। তিনি তা নিয়মিত চালিয়ে যেতেন। এত কিছুর পরও এ মহান ব্যক্তির চেহারায় ক্লান্তির ছোঁয়া দৃষ্টিগোচর হত না। তা ছাড়া তিনি নিয়মিত দস্তারখানা বিছিয়ে খানা খেতেন। কখনো পেঠ পুরে খেতেন না। খানা সম্পর্কিত যাবতীয় দুয়া আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য উচ্চস্বরে পাঠ করতেন। খানার দোষ ত্রুটি বর্ণনা করতেন না। পানি তিন শ্বাসে পান করতেন। এ ছিল এ মহান ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনের রুটিন।
আমি আমার আব্বাজানকে প্রথম জীবনে ও ছাত্রজীবনে এত নিকটে পাই নাই যত নিকটে পেয়েছি বিগত ২৬ এপ্রিল ২০০৫ ইংরেজির পরে। যেদিন হযরত মাওলানা নুর উদ্দিন গহরপুরি রাহ. ইন্তেকাল করেন; তাঁর পরের দিন জানাযায় গিয়ে শুনলাম বুধবার দিন বেলা ১১ ঘটিকার সময় জামিয়া আঙ্গুরার নতুন ভবনের সম্মুখস্থ রাস্তায় হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে কোমরের ডান পার্শের হাড্ডি (কট্টি) ভেঙ্গে গিয়েছে। পরে তাঁকে সিলেট আলবান্না ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করা হয়। অনেক চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। কিছুদিন হুইল চেয়ারে চলার পর অবশেষে স্থায়ীভাবে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এ মহান ব্যক্তির নিকট থেকে যা কিছু অবলোকন করেছি তার কিছুটা নিুে উল্লেখ করলাম।
তিনি এত অধিক ধৈর্যশীল ছিলেন যে, একাধিক পীড়া থাকা সত্ত্বেও কোনোদিন ধৈর্য্যহারা হতে দেখিনি। তিনি এমতাবস্থায় আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে বলতেন, ‘আমি তো অনেক ভালো, আমা থেকে আরও অসুস্থ লোক এ পৃথিবীতে রয়েছে।’
* অন্য কাউকে কষ্ট দিতে চাইতেন না; বরং নিজের প্রয়োজন নিজেই সমাধান করতে চাইতেন।
* সর্বদা আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন, একটি মুহূর্তও অবহেলায় কাটাতেন না।
* প্রতিদিন নিয়মিত কুরআন শরিফ তিলাওয়াত করতেন।
* নিয়মিত সকল নফল নামায আদায় করতেন।
* মেহমান আসলে তাদের খিদমত করার জন্য আমাদেরকে তাগিদ দিতেন।
* সর্বদা আল্লাহর কাছে নিজের এবং মাদরাসার কল্যাণের জন্য মাদরাসার উস্তাদবৃন্দের জন্য, বিশেষ করে মাদরাসার নাজিম মাওলানা জিয়াউদ্দিন সাহেবের হায়াত বৃদ্ধির জন্য আবেগ জড়িত কণ্ঠে প্রার্থনা করতেন।
* পরিবারের কোনো কাজ করার পূর্বে সকলকে নিয়ে পরামর্শ করতেন।
* সর্বদা আমাদেরকে নসিহত করতেন।
* নিজের কর্মের ওপর অন্যের কর্মকে প্রাধান্য দিতেন।
* প্রতিটি কাজে সুন্নাতে নববির অনুসরণ করতেন।
* সতরে আওরাতের প্রতি সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতেন।
* বিবাহ অনুষ্ঠানে জাঁকজমক পছন্দ করতেন না।
* নিজ পরিবারের ছোট-বড় সকলকে সালাম দিতেন। নাতি-নাতনি, ভাতিজা-ভাতিজিকে “আপনে কেমন আছেন, আপনে কি করেন” এ জাতীয় কথা বলে ওদের সাথে আলাপ করতেন। যাতে করে ছোটবেলা থেকে তাদের মধ্যে সু-অভ্যাস গড়ে ওঠে।
* লেন-দেন অত্যন্ত পরিস্কার ছিল, পাওনাদারগণের পাওনা আমাদেরকে দিয়ে খোঁজে খোঁজে আদায় করাতে সচেষ্ট থাকতেন।
* সর্বদা নিজের আমলকে গোপন রাখার চেষ্টা করতেন। কোনো কাজ তাঁর দ্বারা হলে ‘আমার দ্বারা হয়েছে বা আমি করেছি’ বলে নিজের বড়ত্ব জাহির করতেন না।
এবার এ মহান বুযুর্গের জীবনের এমন কয়েকটি গুণের কিয়দাংশ আলোচনা করতে যাচ্ছি, যা আমাদের সকলের জন্য উপকারী হবে বলে আমি মনে করি।
নামাযের প্রতি যতœবান
আব্বাজানের কয়েকটি মারাত্মক রোগ থাকা সত্ত্বেও কোনোদিন রোগের অভিযোগ করেন নাই। প্রথমাবস্থায় হুইল চেয়ারে বসে নিয়মিত মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে আদায় করার জন্য জামাতের প্রায় ১৫ মিনিট পূর্বে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে তাগিদ করতেন। এর ব্যতিক্রম হলে অনেক রাগ করতেন। মাটিতে মাথা রেখে সেজদা না করতে পারায় মহান প্রতিপালকের নিকট অনেক কান্নাকাটি করতেন। মনে হতো তাঁর কলিজা ফেটে যাচ্ছে। নামায এত ধীর স্থির ছিল যে, মনে হতো তিনি একজন সুস্থ ব্যক্তি। নামাযের পর মসজিদের পার্শ্বে অবস্থিত আত্মীয়-স্বজনদের কবর জিয়ারত করতেন। আবার কোনোদিন এ শরীর নিয়ে হুইল চেয়ারে বসে মসজিদের মুসল্লীবৃন্দকে নামায সংক্রান্ত মাসলা-মাসাইল বলে দিতেন। রামাযান মাসে মসজিদে গিয়ে হাফিয সাহেবের পেছনে তারাবির নামায পূর্ণ আদায় করতেন এবং হাফিয সাহেবকে অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে কুরআন শরিফ পাঠ করার জন্য বলতেন। প্রতিদিন ফজরের নামাযে আমাকে বা ইমাম সাহেবকে দিয়ে সুন্নাত কেরাতে নামায পড়াতেন। জুমআর দিনের ফজরের জামাতে সূরায়ে হা-মীম সাজদাহও সূরায়ে দাহর দিয়ে পড়ানোর জন্য আমাকে বলতেন। শয্যাশায়ী অবস্থায় যখন নামাযে যেতে পারতেন না, তখনো ফজরের জামাতের কথা জিজ্ঞেস করতেন। আর মসজিদে যেতে না পারায় আল্লাহর নিকট অনেক কান্নাকাটি করতেন। মারাত্মক ধরনের একাধিক অসুস্থতা সত্ত্বেও এ মহান ব্যক্তির দৈনিক আমলে কোনো ভাটা পড়ে নাই।
কুরআন তিলাওয়াত
কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি এত আশিক ছিলেন যে, প্রথম দিকে হুইল চেয়ারে বসে দৈনিক পাঁচ থেকে ছয় পারা তিলাওয়াত করতেন। আবার কোনোদিন তিলাওয়াত শেষে হাদিসের সবচেয়ে বড় কিতাব বুখারি শরিফ নিয়ে বসে পড়তেন। হাদিস পড়ার প্রতি এত আগ্রহ ছিল যে, আমাকে দিয়ে এক সেট বুখারি শরিফ কিনিয়ে আনান। সুস্থ অবস্থায় প্রতি রামাযান মাসের শেষ ১০ দিনে মসজিদে এতেকাফ করতেন এবং দৈনিক এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। শয্যাশায়ী অবস্থায় যখন বসে বসে তিলাওয়াত করতে পারতেন না। কুরআন শরিফ পাঠ করতে পারতেন না, তখন তাঁর নির্দেশে পৃথক পৃথক পারায় বিভক্ত এক সেট কুরআন কিনে নিয়ে আসা হয়। যখনই অবসর হতেন তখনই কুরআন শরিফের এক একটি পারা হাতে নিয়ে শুয়ে শুয়ে পড়তেন। এ অবস্থায়ও প্রতি রামাযান মাসে ছয় থেকে সাত খতম কুরআন শরিফ পাঠ করে ফেলতেন। তাঁর জীবনের শেষ রামাযান মাসে যখন তাঁর পক্ষে হাত উঁচু রেখে কুরআন শরিফ পড়া অনেক কষ্ট হচ্ছিল তখনও ছয়বার কুরআন মজিদ খতম করেন। যা একজন সুস্থ সবল মানুষের পক্ষে সাধারণভাবে সম্ভব হয় না।
মরহুম শায়খ রাহ.এর আরেকটি আশ্চর্যজনক গুণ ছিল, যে কোনো সময় আরবি তারিখ বলে দিতে পারতেন। আমি জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আরবি মাসের তারিখের সাথে মিল রেখে কুরআন তিলাওয়াত করি বিধায় তা বলতে পারি। এতে বুঝা গেল, এ মহান ব্যক্তির দৈনিক তিলাওয়াতে কোনো ব্যতিক্রম ঘটত না।
নফল নামায ও রোযা
শায়খ রাহ. তাঁর জীবনে নানা ব্যস্ততার ভিতর দিয়েও সবধরনের নফল নামায ও নফল রোযায় অভ্যস্ত ছিলেন। মাগরিব ও এশার নামাযের পর দীর্ঘক্ষণ নফল নামায পড়তেন। শয্যাশায়ী অবস্থায়ও তার আমলে কোনো ধরনের ত্রুটি পলিক্ষিত হত না। তাঁর ইন্তেকালের প্রায় সপ্তাহখানেক আগে একদিন মাগরিবের পরে নফল নামায শেষে তাঁকে খুবই অনুশোচনা করতে দেখি। তা দেখে জিজ্ঞেস করলাম, আব্বাজান এরূপ করছেন কেন? তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি আজ মাগরিবের নামাযের পর কয় রাকাত “সালাতুল আউওয়াবিন” পড়েছি তাঁর হিসাব মিলাতে পারিনি। আমার জীবনে এরকম আর কখনো হয়নি। প্রতি বছরের ন্যায় জীবনের শেষ রামাযান মাসের ৩০টি রোযা রাখার পর শাওয়াল মাসের ৬টি রোযাও রেখেছেন।
মেহমান নওয়াজি
মেহমানদারির প্রতি তিনি খুব লক্ষ্য রাখতেন। কোনো মেহমান আসলেই সাথে সাথে আমাদেরকে ডেকে খাওয়ার জন্য কোনোকিছু নিয়ে আসতে বলতেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি নিয়ে এসেছ তাও জিজ্ঞেস করতেন। একটু বিলম্ব হলে রাগ করতেন। তাঁর জীবনের প্রথম দিকে তিনি নিজেই মেহমানদের খিদমতে লেগে যেতেন। কে কী খাবেন তা জিজ্ঞেস করে পরিবেশন করার জন্য সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। দুর্বলতার দরুন তিনি বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারতেন না। তাই তাড়াতাড়ি তাঁকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হত। কিন্তু মাদরাসার কোনো উস্তাদ বা ছাত্র আসলে তাড়াতাড়ি চেয়ারে বসিয়ে দেওয়াার কথা বলতেন। এ অবস্থায় তাদের সাথে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করতেন। নিজের শরীরের দুর্বলতা টেরই পেতেন না।
প্রতি বছর আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদরাসার শিক্ষাসচিব ও বর্তমান মুহতামিম মাওলানা জিয়া উদ্দিন সাহেব দা. বা. তাকমিল ফিল হাদিসের ছাত্রদেরকে নিয়ে আমাদের বাড়ির মসজিদে আসতেন। নাজিম সাহেব হুজুরের আগমনের কথা শুনামাত্র তিনি বিচলিত হয়ে পড়তেন। তাদেরকে আপ্যায়ন করানোর জন্য কয়েক দিন পূর্ব থেকে আমাদের সকলকে একত্রিত করে ব্যবস্থাপনার জন্য পরামর্শ দিতেন। ঠিক সময়ে মসজিদে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলতেন। অথচ এ মহান ব্যক্তির শরীরের এমন অবস্থা ছিল যে, নিজেই তাঁর শরীরের ওপর আস্থা রাখতে পারতেন না। বলতেন ‘আমার মনে হয় এবার আমি তাদেরকে মসজিদে গিয়ে বায়আত করাতে পারব না।’ কিন্তু নির্ধারিত তারিখ আসলে তিনি সকাল থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন এবং সুন্দর জামা-কাপড় পরিয়ে দেওয়ার কথা বলতেন। এরপর আমরা তাঁকে গোসল করিয়ে জামা কাপড় পরিয়ে নিজ বিছানায় শুইয়ে দিতাম। মেহমানরা এসে একে একে তাঁর সাথে মোলাকাত করতেন। আমি আব্বাজানের চেহারার পানে গভীরভাবে তাকিয়ে দেখতাম তাঁর চেহারায় নূরানি আলো চমকাচ্ছে। পরে তাঁকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে মসজিদে নিয়ে যাওয়া হত। প্রথমে নাজিম সাহেব দা. বা. ছাত্রদের উদ্দেশে নসিহত করতেন। এরপর হযরত শায়খ রাহ. বুখারি শরিফের শেষ হাদিসের ব্যাখ্যা করে ছাত্রদেরকে মুরিদ করে তাসাউফের সবক বলে দিতেন। ওই দিন তাঁর চেহারায় কোনো ধরনের কষ্ট পরিলক্ষিত হত না। এটি তাঁর জীবনের একটি কারামত বলে আমি মনে করি।
সুন্নাতে নববির অনুসরণ
আমি আব্বাজান রাহ.কে কোনোদিন সুন্নতের পরিপন্থী কোনো কাজ করতে দেখিনি। সব কাজে নবী করীম সা. এর তরিকার অনুসরণ করতেন এবং আমাদরেকেও তা করতে বলতেন। একদিন আববাজানকে জামা পরাচ্ছিলাম, ভুলক্রমে বাম হাত আগে পরিয়ে দিলে তিনি অত্যন্ত ধমকের স্বরে বললেন ‘আগে ডান হাত পরে বাম হাত পরিয়ে দাও? খোলার সময় প্রথমে বাম হাত পরে ডান হাত খুলবে। এ রকম আর যেন না হয়।’ প্রস্রাব পায়খানাসহ যাবতীয় কাজ সুন্নাতে নববরি পরিপন্থী হলে খুব রাগ করতেন। মোটকথা মহান বুযুর্গের তবিয়ত শরিয়তে পরিণত হয়েছিল, যার দরুন জীবনের অন্তিম সময়ে সুন্নতের বরখেলাফ কোনো কাজ সংঘটিত হয়নি। সতরে আওরাতের প্রতি এতটুকু খেয়াল রাখতেন যে, কোনো দিন কারো সম্মুখে বের করাতো দূরের কথা একাও করতেন না। যার জ্বলন্ত প্রমাণ আমি তাঁর জীবনের অন্তিম সময়ে পেয়েছি। যখন তিনি শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিলেন; নিজ ছেলে হওয়া সত্ত্বেও প্রথম দিকে কোনোদিন হাটুর উপরিভাগে মালিশ করাতেন না। শেষ অবস্থায় শরীরের পীড়া বেশি হলে আমার অনুরোধে তা করাতে বাধ্য হন। তখনও তিনি অনেক সঙ্কোচতা বোধ করতেন। আমাকে অন্য কারো সামনে না করার জন্য বলতেন। বেহুঁশ অবস্থায় যখন তিনি নামায পুরোপুরি আদায় করতে পারতেন না তখনও সতরে আওরতের প্রতি এতটুকু খেয়াল রাখতেন যে, কখনো কাপড় সরে গেলে হাত দ্বারা আমাদেরকে ইশারা করতেন। কখনো পুত্র-বধুদ্বয়ের সামনে আমাদের থেকে খিদমত নিতেন না।
দুনিয়া বিমুখতা ও লোভ-লালসাহীনতা
এ মহা মনীষীর জীবনে কখনো পার্থিব দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ ছিল না। তাঁর জাগতিক জ্ঞান ছিল প্রচুর বিধায় অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হতে পারতেন। অন্যান্য লোকদের মত গাড়ি-বাড়ি করতে পারতেন। তদুপরি পার্থিব দুনিয়ার প্রতি ধাবিত হননি। কিন্তু তিনি ওই দিকে না গিয়ে দ্বীনের খিদমতকে তাঁর জীবনের ব্রত হিসাবে নিয়েছেন। মসজিদ ও মাদরাসার খিদমতকে তাঁর জীবনের সম্বল বানিয়েছেন। মসজিদ ও মাদরাসার খিদমত করে যে হাদিয়াটুকু পেতেন, তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চালাতেন। মাদরাসার খিদমতের ফাঁকে ফাঁকে কষ্ট করেও বিভিন্ন ধরনের ছোট-খাট ব্যবসা করতেন। অন্যের সম্পদের প্রতি মোটেই তাঁর লোভ ছিল না। তিনি তাঁর অন্যান্য ভাইদেরকে সবধরনের আর্থিক সুযোগ দিয়ে নিজে সাধারণ জীবন যাপন করতেন। এ মহান ব্যক্তি তাঁর মাদরাসার কাজে চার বার লন্ডন যান, সেখানে মাদরাসার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা কালেকশন করেন। কিন্তু নিজের জন্য একটি টাকাও আনেন নি। সেখানে কেউ তাঁকে টাকা হাদিয়া দিলে বলতেন, আমি আমার মাদরাসার টিকেটে চাঁদার জন্য লন্ডনে এসেছি। আমার পকেট ভারি করার জন্য আসিনি। সেখানকার কয়েকজন প্রবাসী লোক আমার আব্বাজানকে বললেন, আপনার ছেলেদ্বয়কে লন্ডনে নিয়ে আসেন আমরা তাদের বিবাহসহ সবধরনের ব্যবস্থা করব। তিনি অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। আমিও তাঁকে অনেক বার বলেছিলাম, কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে অধিক ধন-সম্পদকে মোটেই ভালোবাসতেন না। সাধারণভাবে জীবন যাপন করাকে ভালোবাসতেন। লন্ডন প্রবাসীগণ একবার একত্রিত হয়ে তাঁর গৃহ নির্মাণ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন। সিদ্ধান্ত জানানোর ভার তাঁদের পক্ষ থেকে লন্ডন প্রবাসী মাওলানা মুঈনুল হক চৌধুরিকে দেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্ত আব্বাজানকে জানানো হলে তিনি কোনো অবস্থাতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি বললেন, আমার প্রয়োজন থেকে মাদরাসার প্রয়োজন বেশি। তাই আপনারা উক্ত টাকাগুলো মাদরাসায় পাঠিয়ে দিন। পরে মাওলানা মুঈনুল হক চৌধুরি সাহেব আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদরাসার নাজিম (মাওলানা জিয়া উদ্দিন) সাহেবকে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর তাঁকে রাজি করালেন। কিন্তু তাঁর মনে একটুও শান্তি মিলেনি। যখন গৃহনির্মাণের জন্য মাওলানা ফয়জুর রহমান সাহেবের নিকট টাকা আসতে লাগল, তখন তিনি মাওলানাকে একান্তে নিয়ে বললেন, টাকাগুলো আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদরাসায় দান করে দাও। মাওলানা বললেন, উক্ত টাকাগুলো আপনার ঘর নির্মাণের জন্য আমাকে আমানত হিসাবে দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় এ টাকা আমি প্রেরকের নিকট পাঠিয়ে দেব। এ থেকে বুঝা যায় হযরত মাদরাসার প্রতি কতটুকু দরদি ছিলেন। ঘর নির্মাণে তাঁকে যখন বাধ্য করা হল, তখন কিভাবে কম খরচে ঘর বানানো যায় তার জন্য মিস্ত্রী ডেকে এনে সকলকে নিয়ে পরামর্শ করতে বসলেন। তখন কেউ বললেন পাকা দিয়ে ছাদ ঢালাই করে বানানোর জন্য। কিন্তু তাতে তিনি রাজি হলেন না। তিনি টিনশেডের ঘর নির্মাণ করার জন্য বললেন এবং তাঁরই মতানুযায়ী প্রথমে নিজে ঘরের নকশা আমাকে দিয়ে আঁকলেন। পরবর্তীতে ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল সাহেবের মাধ্যমে একটি নকশা তৈরি করালেন। কিন্তু আমি আব্বাজানকে না জানিয়ে সিলেট গিয়ে জনাব ইঞ্জিনিয়ার মঈনুল ইসলাম সাহেবের মাধ্যমে আরেকটি ঘরের নকশা তৈরি করে নিয়ে আসি। পরে সকলের পরামর্শের মাধ্যমে আমার নকশা গৃহীত হয় এবং সে নকশানুযায়ী ঘর নির্মাণ করা হয়। এতে আব্বাজান মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি আমাকে বারবার এ কথা বলতেন, ‘তুমি মোটেই কাজটি ভালো করো নাই। তুমি অধিক জাঁকজমকে মেতে ওঠেছ। তুমি আমাকে লোকদের সম্মুখে শরমিন্দা করতে চাচ্ছ।’ এরপর মিস্ত্রী সাহেবকে ডেকে এনে বললেন, ‘ঘর যেন কম খরচে হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখবেন।’ তাই অল্প খরচের দিকে লক্ষ্য রেখে বাড়ির সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করে পূর্বমুখী করে ঘর নির্মাণ না করে দক্ষিণমুখী করে ঘর নির্মাণ করেন। এতো কিছুর পরও এ মহান ব্যক্তি আল্লাহর নিকট আহাজারি করে বলতেন, ‘মনে হয় আল্লাহ যেন আমাকে ভাল কাজের প্রতিদান দুনিয়াতে দিয়ে দিলেন?’ এ ছিল তাঁর দুনিয়া বিমুখতার নযির।
তাঁর অনাড়ম্বর জীবনের স্মৃতি চারণ
এ মহান ব্যক্তির জীবনের চমৎকার দিক আলোচনা করতে গিয়ে আমার আম্মাজান বলেন, তিনি একটি ঐতিহ্যবাহী মাদরাসার মুহতামিম হওয়া সত্ত্বেও অনাড়ম্বর জীবন-যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। তিনি বলেন, প্রথম দিকে মাদরাসায় থাকাকালীন সময়ে পরার জন্য তোমার পিতার একটি বা দুটি পাঞ্জাবি ছিল। যা দিয়ে কোনো মতে দিন অতিবাহিত করতেন। প্রায় সকালে বাড়িতে এসে পরনের পাঞ্জাবি খুলে দিয়ে বলতেন, এটি তাড়াতাড়ি ধুয়ে পরিস্কার করে দাও? আমি ওই পাঞ্জাবি পরে মসজিদে গিয়ে যোহরের নামায বা জুমআর নামায পড়াব। তাছাড়া একেকটি পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি প্রায় আট থেকে দশ বছর পর্যন্ত পরতে পারতেন। তার পরও তা অব্যবহার যোগ্য হতো না। এটি ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কঠোর পরিশ্রম। আমার আম্মাজান বলেন, তোমার পিতা মাদরাসার জন্য যে পরিমাণ পরিশ্রম করেন তার কিছু অংশ যদি নিজ পরিবারের জন্য ব্যয় করতেন তাহলে আমাদের আর্থিক অবস্থা অনেক উপরে চলে যেত। কিন্তু তিনি তা না করে আমাকে ধৈর্য্যরে সাথে জীবন-যাপন করার জন্য নসিহত করতেন। এবং বলতেন আল্লাহর শুকরিয়া কি আদায় করবো, আজ পর্যন্ত এক বেলা না খেয়ে থাকি নাই। এ ছিল তাঁর জীবনের বাস্তব চিত্র। মাদরাসাই যেন ছিল তাঁর জীবনের আসল সম্পদ তা নিচের ঘটনা দ্বারা বুঝতে পারবেন। আম্মাজান বলেন, ছায়রা নামে তোমার এক বড় বোন ছিল। জন্মের কয়েকদিন পর মারা গেলে সাথে সাথে তোমার পিতাকে সংবাদ জানানো হল। মাদরাসার বার্ষিক ওয়াজ সামনে থাকায় তিনি নিজের কলিজার টুকরা মেয়েকে শেষ বারের মতো এক নজর দেখতে আসেননি। আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর থেকে আমাদের বাড়িতে আসতে তখনকার সময় এক ঘণ্টা লাগত, অথচ জলসার পরের দিন এসে আমাকে শান্তনা দিতে লাগলেন।
শায়খ রাহ.র মাদরাসার জন্য এতো দরদ ছিল যে, শেষ জীবনে শয্যাশায়ী অবস্থায়ও তিনি তাঁর হাতে গড়া মাদরাসায় যাওয়ার জন্য অস্তির হয়ে পড়তেন। মাদরাসার জলসার তারিখে গাড়ি রিজার্ভ করার কথা বলতেন। তাঁর এ আগ্রহ দেখে মাদরাসা-কর্তৃপক্ষ একাধিকবার গাড়িযোগে মাদরাসার জলসায় তাঁকে নিয়েছেন। শেষবারে তাঁকে যখন মাদরাসায় নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না, তখন তিনি মাদরাসার জলসার তারিখ জিজ্ঞেস করে আক্ষেপ করে বলতেন ‘আমি কি আর মাদরাসায় যেতে পারব না!
আব্বাজান রাহ. বিয়ে-শাদিতে বর্তমান আধুনিকতাকে কখনো পছন্দ করতেন না। সমাজ থেকে এ কুসংস্কার দূরীভূত করার লক্ষ্যে তিনি আজীবন চেষ্টা চালিয়ে যান। সমাজের সম্মুখে নিজ সন্তানদিগকে বিবাহ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করে এর নযির রেখে গিয়েছেন। আব্বাজান রাহ. আমাদের সকলকে সম্পদশালী উঁচু পরিবারে বিবাহ দিতে পারতেন। প্রস্তাবও এসেছিল। কিন্তু তিনি তা পরিহার করে দ্বীনদারি ও পর্দার দিকে লক্ষ্য রেখে আমার সকল বোনকে দ্বীনদার পাত্রের সাথে বিবাহ দেন। অথচ তাদের কেউই সম্পদশালী ছিলেন না। কোনো মতে তাদের জীবিকা নির্বাহ হত। প্রত্যেক বিবাহের আকদের খরচ নিজে বহন করেন। তদ্রƒপ আমরা দুই ভাইকেও অতি সাধারণ দ্বীনদার পরিবারের পর্দানিশীন মহিলার সাথে বিবাহ দেন। বিয়ের দিনের আনুষ্ঠানিকতা না করে মসজিদে আকদ সম্পাদন করেন। আনুষ্ঠানিকতা না থাকায় অনেক আত্মীয়-স্বজন বিবাহে উপস্থিত হননি। অবশ্য পরদিন ওয়ালিমা করেন। ওয়ালিমায় কোনো ধরনের উপহার সামগ্রী নিয়ে না আসার জন্য সকল আত্মীয়-স্বজনকে পূর্বেই অবহিত করতেন। কেউ নিয়ে আসলে তা তিনি ফেরত দিয়ে দিতেন। এ ছিল এ মহান ব্যক্তির অনাড়ম্বর জীবনের স্মৃতি।
শায়খ রাহ.’র এর দৈনিক আমলের রুটিন
শায়খ রাহ. ফজরের পর তাসবিহ তাহলীল করে কিছুক্ষণ তিলাওয়াত করতেন। এরপর ইশরাকের নামায। এরপর কিছু সময় আরাম করে চাশতের নামায পড়তেন। দীর্ঘক্ষণ কুরআন শরিফ তিলাওয়াত করে আবার কিছুক্ষণ আরাম করতেন। যোহরের নামায পড়ে কোনোদিন তিলাওয়াতে বসতেন, কোনোদিন মেহমান আসলে তাদের সাথে আলাপ করতেন। তারপর নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজন সারতেন। আবার কোনোদিন যোহরের নামায পড়ে তিলাওয়াতে বসে পড়তেন। আসর পর্যন্ত আরাম করতেন। আসরের নামায পড়ে মাগরিবের নামায পর্যন্ত তাসবিহ পাঠ করতেন। মাগরিবের নামায পড়ে দীর্ঘক্ষণ নফল নামায পড়তেন। তারপর সূরায়ে ওয়াকিয়াহ তিলাওয়াত করতেন। এশার নামায পড়ে সূরায়ে মুলক তিলাওয়াত করতেন। আবার কখনো আমাদেরকে বিভিন্ন দিক দিয়ে নসিহত করতেন। আবার কোনোদিন নফল নামাযে মশগুল হয়ে যেতেন। তারপর খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়তেন। শেষ রাতে ওঠে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে দীর্ঘক্ষণ আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। ফজর পর্যন্ত তিলাওয়াত করতেন। মেহমান এলে অথবা শরীরের অবস্থা পরিবর্তন হলে তাঁর দৈনিক রুটিনে কিছুটা পরিবর্তন হত। এতো আমলের পরও শায়খ রাহ. বলতেন, আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে অবসর করে দিয়ে পরীক্ষা করছেন যে, আমি তাঁর নিকট কী আমল নিয়ে উপস্থিত হই।
তাঁর ইন্তেকালের পূর্বের ২০ দিন
আমার চাচা মরহুম হাফিয মাওলানা আবদুল করিম সাহেবের ইন্তেকালের সংবাদ শ্রবণের পর আব্বাজানের শরীর অত্যাধিক খারাপ হয়ে যায়। তখন থেকে তিনি নিজে তায়াম্মুম করতে পারতেন না, আমিও আমার মাতা পর্যায়ক্রমে তাঁকে প্রত্যেক নামাযের সময় তায়াম্মুম করিয়ে দিতাম। এ অবস্থায়ও তিনি তাঁর নিয়মিত আমল চালিয়ে যেতেন। কোনোদিন এমন হতো যে, কয় রাকাত নামায পড়েছেন তা ঠিক করতে না পেরে কেঁদে ফেলতেন। মাঝে মধ্যে তাঁর হুঁশ চলে যেত। হুঁশ যখন ফিরে আসত তখন বলতেন, “নামাযের সময় কি চলে গেছে? তাড়াতাড়ি তায়াম্মুম করিয়ে দাও।”
এ মহামনীষী শয্যাশায়ী অবস্থায় জীবনের অন্তিম সময়ে স্বপ্নে কোনো দিন হযরত শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি রাহ. কে, আবার কোনোদিন হযরত মাওলানা আবদুল মতিন চৌধুরি শায়খে ফুলবাড়ি রাহ. কে দেখতেন। আবার উভয় বুযুর্গের সাথে আরো অনেককে একসাথে দেখেছেন বলে উল্লেখ করেন।
আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদরাসার কোনো উস্তাদ এলে তাদের সঙ্গে তাঁর শরীরের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করে বলতেন, আমি আপনাদের মর্যাদানুযায়ী খিদমত করতে পারি নাই বিধায় আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। এরপর বলতেন, আমার হালতের ওপর দুয়া করবেন আল্লাহ্ তা’য়ালা যেন আমাকে খাতেমা বিল খয়ের নসিব করে তাঁর পাশে নিয়ে যায়। এ অবস্থায়ও ইন্তেকালের কয়েকদিন পূর্বে আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদরাসার নাজিম সাহেবের হাতে টাকা দিয়ে শুক্রবারে মৃত্যু হওয়ার জন্য সকল উস্তাদবৃন্দকে নিয়ে দুয়া করানোর কথা বলেন। এভাবে আরো কয়েকদিন চলে যায়।
তাঁর অন্তিম সময়ের অবস্থা
অবশেষে ২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৩ই ফাল্গুন ১০ই রবিউল আউয়াল ২০১০ ইসায়ি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত মাগরিবের পর থেকে তাঁর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। মাগরিবের নামাযের পর বেহুঁশ অবস্থাতে তাকবিরে তাহরিমা বলে হাত বাঁধতে থাকেন এবং ছাড়তে থাকেন। এভাবে অনেকবার তাঁর এ অবস্থা দেখে আমরা পরিবারের সকল সদস্য তাঁর শিয়রে একত্রিত হলাম এবং তাঁর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। একটু পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আব্বাজান আপনার শরীরের অবস্থা কিরূপ? তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে এভাবে তাঁর কাজ এশা পর্যন্ত চালিয়ে যান। এশার নামাযের সময় হলে আমাকে সম্বোধন করে বললেন, আমাকে তায়াম্মুম করিয়ে দাও। আমি তাঁকে তায়াম্মুম করিয়ে মসজিদে চলে যাই। এরপর দ্বিতীয় পূত্রবধুকে উদ্দেশ করে বলেন, আমাকে পশ্চিমমুখী করে দাও। অন্যান্য দিনের মতো পশ্চিমমুখী করে দিলেও তিনি আবার বললেন, আরও বেশি করে দাও। তারপর এ অবস্থাতে কয়েক রাকাত নামায পড়েন। আমরা সকলেই তাঁর নিকট ক্ষমা চেয়ে নিলাম। তিনি হাসি মুখে আমাদের সকলকে ক্ষমা করে দিয়ে বললেন, বাড়ির সকলকে নিয়ে এসো। সকল একত্রিত হলে সকলকে নসিহত করে একে একে সবার কাছ থেকে শেষ বারের মত ক্ষমা চেয়ে নিলেন। এরপর আর কোনো কথা না বলে চোখ বুজে নিলেন। আমরা সকলে তার পাশে বসে থাকলাম। রাত গভীর হতে লাগল। তাঁর অবস্থাও অবনতি হতে থাকল। রাত প্রায় আড়াইটা। দেখলাম, আব্বাজান স্বীয় হাত দ্বারা চেহারা মোবারক মুছতে লাগলেন। আমরা তাঁর এ অবস্থা দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলতে থাকি যিনি এতো দিন নিজ চেহারায় হাত দিয়ে তায়াম্মুম করতে পারেন নাই, এখন কিভাবে আপন চেহারা মুছতে পারলেন! আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আব্বাজান! আপনার কি কোনো কষ্ট হচ্ছে?’ আব্বাজান বললেন, ‘তোমরা শব্দ করো না আল্লাহ এবং তাঁর প্রিয় হাবিবের সাথে আমার আলাপ হচ্ছে’ এরূপ অনেক্ষণ কেটে যাওয়ার পর, আব্বাজান পানি দাও পানি দাও বলে আমাদের দিকে ইশারা করলেন। কয়েকবার পানি পান করার পর অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
পরদিন শুক্রবার। ফজরের নামাযের পর ডাক্তার ডেকে স্যালাইন পুশ করা হল। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হল না। শ্বাস-প্রশ্বাস আরো তীব্রতর হতে লাগল। আমরা তাঁর অবস্থা বেগতিক দেখে চারিদিকে মোবাইল ফোনে সকলকে সংবাদ জানালাম। সংবাদ শুনে চারিদিক থেকে পিপিলিকার মতো তাঁর ভক্তবৃন্দ, বিভিন্ন মাদরাসার উস্তাদ, ছাত্র, হযরতের শুভাকাঙ্খীরা তাঁকে এক নজর দেখার জন্য আমাদের বাড়িতে ভিড় জমাতে থাকেন। আবেগজড়িত কণ্ঠে সকলেই কাঁদতে থাকেন। তাঁকে সামনে রেখে তাঁর জন্য কয়েকবার মোনাজাত করা হয়। কেউ তাঁর হাত-পা, মালিশ করে দেন। এ অবস্থাতে জুমুআর নামাযের সময় হলে সকলেই নামাযে চলে যান। আমার আম্মাজান, চাচাত বোন ও তাঁর পূত্রবধুদ্বয়কে শিয়রে রেখে আমিও নামাযের উদ্দেশ্যে চলে যাই। পথিমধ্যে হঠাৎ আমার মনে কি যেন জেগে উঠল। আমি আবার আব্বাজানের নিকট ফিরে আসি। এরপর গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলাম আব্বাজান আগের চেয়ে আারও ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলছেন। প্রতি শ্বাসে জিহবা টেনে টেনে “আল্লাহু আল্লাহু” বলার ধ্বনি শুনা যাচ্ছে। এরপর এদিক ওদিক কয়েকবার তাকালেন। কলিমা শাহাদত পাঠ করলেন। কালেমা পাঠ করেই বেলা ০১:১০ মিনিটের সময় এ নশ্বর পৃথিবী থেকে চির বিদায় গ্রহণ করে তাঁর পরম প্রিয় মাওলার সাথে মিলিত হন। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের সু-উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করুন!আমীন।
লেখক: শিক্ষক, মাথিউরা দারুল কুরআন মাদরাসা